Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিয়েতে নাক গলাবে না খাপ, রায় সুপ্রিম কোর্টের

ভিন্ন জাত বা ধর্মের মানুষকে বিয়ে করে খাপ পঞ্চায়েতের কোপে পড়ার অভিযোগ উঠেছে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, এমনকী বিহার ও তামিলনাডু থেকেও।

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৮ ০৪:১৬
Share: Save:

দুই প্রাপ্তবয়স্কের বিয়েতে খাপ পঞ্চায়েত বা ওই ধরনের কোনও সংগঠনের নাক গলানোর অধিকার নেই বলে রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। খাপ পঞ্চায়েতের এমন আচরণ ‘সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ’ বলে আজ মন্তব্য করেছে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।

ভিন্ন জাত বা ধর্মের মানুষকে বিয়ে করে খাপ পঞ্চায়েতের কোপে পড়ার অভিযোগ উঠেছে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, এমনকী বিহার ও তামিলনাডু থেকেও। সম্মানরক্ষার নামে খুন এবং পাত্র-পাত্রী ও তাদের পরিবারের উপরে হামলারও বহু অভিযোগ রয়েছে। এমন ঘটনায় পুলিশ যে সব সময়ে মহিলাদের সুরক্ষা দিতে পারে না, আজ আদালতে তা মেনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারও।

এই ধরনের ঘটনা রুখতে এবং দম্পতির সুরক্ষা চেয়ে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল ‘শক্তি বাহিনী’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেই মামলাতেই আজ এই রায় দিল প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি এ এম খানউইলকর ও বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। এ ধরনের ঘটনা রুখতে একটি নির্দেশিকাও দিয়েছে বেঞ্চ। বলা হয়েছে, সংসদে এ নিয়ে আইন তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত ওই নির্দেশিকা জারি থাকবে। রায় ঘোষণার পরে ‘শক্তি বাহিনী’র অধিকর্তা রবিকান্ত বলেন, ‘‘আজকের যুবসমাজ জাতপাতের

শেকল ভাঙতে চায়। এই রায়ে জয় হয়েছে তাদেরই। এই রায়ের পরে তারা পুলিশ-প্রশাসনকে পাশে পাবে।’’

মামলার রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রই। ৫৪ পাতার রায়ের শুরুতে ফরাসি দার্শনিক সিমোন ওয়াইলকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘‘স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হল— কোনও কিছু বেছে নেওয়ার ক্ষমতা।’’ বেঞ্চের মতে, জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সে জন্য পরিবার বা সম্প্রদায়ের অনুমতির প্রয়োজন নেই।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশিকা

প্রতিরোধে

•গত পাঁচ বছরে কোন কোন গ্রাম, মহকুমা ও জেলায় সম্মানরক্ষায় খুন বা খাপ পঞ্চায়েত গঠনের ঘটনা ঘটেছে, রাজ্য সরকারকে তা চিহ্নিত করতে হবে।

•চিহ্নিত এলাকার প্রতিটি থানার ওসিকে বিশেষ ভাবে নজর রাখতে হবে, ভিন্ন জাত বা ভিন্ন ধর্মের বিয়ে ঘটছে কি না। ওসিরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে জেলার এসপিকে। এ বিষয়ে এসপিদের নির্দেশিকা পাঠাবেন স্বরাষ্ট্রসচিব।

•পুলিশ বা জেলা প্রশাসনের অফিসার কোনও খাপ পঞ্চায়েতের খবর পেলে তৎক্ষণাৎ উর্ধ্বতন অফিসারকে জানাবেন। খবর দিতে হবে এসপি এবং ডিএসপিকেও।

•খবর পেলেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তাকে খাপ পঞ্চায়েতের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোঝাতে হবে, এ ধরনের জমায়েত বেআইনি। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে নিশ্চিত করতে হবে যে, এ ধরনের জমায়েত যাতে না হয়।

•এরপরেও জমায়েত হলে ডিএসপিকে সেখানে গিয়ে খাপ সদস্যদের বোঝাতে হবে যে, তাঁরা এমন কোনও সিদ্ধান্ত যেন না নেন যার ফলে প্রেমিক যুগল বা তাদের পরিবারের কোনও ক্ষতি হয়। অন্যথায় শুধু বৈঠকের সংগঠক নয়, জমায়েতে উপস্থিত সকলের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি ধারায় মামলা দায়ের করা হবে। উপস্থিত পুলিশকর্তাকে বৈঠকের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করতে হবে।

•উপস্থিত পুলিশকর্তা যদি বুঝতে পারেন, খাপ পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তের ফলে প্রেমিক যুগল বা তাদের পরিবারের কোনও ক্ষতি হতে পারে, তা হলে তিনি জেলাশাসক বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তাকে অনুরোধ করবেন, যাতে তাঁরা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ও ১৫১ পরিচ্ছেদ অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও গ্রেফতারে অনুমতি দেন।

প্রতিকারে

•যদি খাপ পঞ্চায়েতের কোনও জমায়েত সংগঠিত হয় বা প্রেমিক যুগল বা তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষতিকারক নির্দেশিকা জারি হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪১, ১৪৩, ৫০৩ ও ৫০৬ ধারায় এফআইআর দায়ের করবেন।

•প্রেমিক যুগল/ নবদম্পতি বা তাদের পরিবারের প্রাণহানি বা বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে তাদের অন্য কোথাও সেফ হাউসে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে থাকতে পারবেন— ক) অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে, যাঁদের সম্পর্ক তাঁদের পরিবার বা সমাজ বা স্থানীয় খাপ পঞ্চায়েত মেনে নিচ্ছে না। খ) নববিবাহিত দম্পতি যাঁরা ভিন্ন ধর্ম বা জাতে বিয়ে করেছেন এবং পরিবার বা সমাজ বা স্থানীয় খাপ পঞ্চায়েত যে বিয়ে মেনে নিচ্ছে না।

•কোনও ছেলে-মেয়ে বা তাদের পরিবার পুলিশ বা প্রশাসনকে হুমকির কথা জানালে দেখতে হবে যে সংশ্লিষ্ট যুগল প্রাপ্তবয়স্ক কি না। তারা প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ে ও বিয়ের পঞ্জিকরণে সাহায্য করতে হবে। নববিবাহিত দম্পতি চাইলে নামমাত্র মূল্যে সেফ হাউসে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। অন্তত এক মাস তারা সেখানে থাকতে পারবে। প্রতি মাসে সেখানে থাকার অনুমতি বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু এক বছরের বেশি নয়।

• এ ধরনের অভিযোগ দায়ের হলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বা সমমর্যাদার কোনও পুলিশ অফিসার এক সপ্তাহের মধ্যে পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত রিপোর্ট দেবেন

•রিপোর্ট পেলেই পুলিশ সুপার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেবেন, যাতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ পরিচ্ছেদ অনুসারে এফআইআর করা হয়।

কী শাস্তি

•পুলিশ-প্রশাসনের কেউ নির্দেশ পালন না করলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

•গাফিলতির জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রাজ্যের। এই ব্যবস্থা তখনই নেওয়া হবে, যদি দেখা যায়— কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে, সে বিষয়ে খবর থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট অফিসার তা থামানোর চেষ্টা করেননি, বা হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

•ভিন্ন জাত বা ধর্মের প্রেমিক যুগল বা দম্পতির অভিযোগ দায়ের করার জন্য বিশেষ সেল তৈরি করবে রাজ্য।

মামলায় খাপ পঞ্চায়েতগুলোর বক্তব্যও শুনেছে বেঞ্চ। খাপের আইনজীবীরা জানান, প্রকৃতপক্ষে তারা অসবর্ণ বিয়েতেই উৎসাহ দেয়। কারণ, হিন্দু বিবাহ আইনে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের বিরোধিতা করা হয়েছে। রায় ঘোযণার পরে খাপের তরফে জানানো হয়, যতই আদালত নির্দেশ দিক, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের কোনও ঘটনা ঘটলে তারা তার বিরোধিতা করবেই। সর খাপ পঞ্চায়েত কোঅর্ডিনেটর ও পি ধানকরের কথায়, ‘‘নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের বিরুদ্ধে আমরা। তা ছাড়া গ্রামতুতো সম্পর্কের খাতিরে একই গ্রামের ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়েও আমরা অনুচিত বলে মনে করি।’’

‘শক্তি বাহিনী’র অধিকর্তা রবিকান্তের কথায়, ‘‘ভারতের প্রতিটি ঘরে ঘরে অদৃশ্য খাপ পঞ্চায়েত চলে। রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে খাপের চাপে পড়ে সম্মানরক্ষায় খুনের ঘটনা বাড়ছে। আগে পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ঘটনা কম শোনা গেলেও, গত কয়েক বছরে সেখান থেকেও কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি।’’ আজকের রায়ে ভিন্ন জাত বা ধর্মের দম্পতিরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলেন বলে আশা রবিকান্তের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Khap panchayat Supreme Court marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE