Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

তিন কিলোমিটার অন্তর মদের ঠেক, মান্ডি কই!

রক্তাক্ত পায়ে কৃষকের লং মার্চ কাঁপিয়ে দিয়েছে দেশকে। অব্যাহত আত্মহত্যা। খরা, ঋণের বোঝা, ফড়ের দাপট নিয়ে কেমন আছেন কৃষকেরা?গ্রামের ফিসফাস— এলাকায় এজেন্টদের এত বাড়বাড়ন্ত কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের জন্যই। যে সব চাষি গাড়ি ভাড়া করে দূরে গিয়ে স্টোরেজে আলু বেচতে চান, তাদের নানাভাবে লুট করা হয়।

পুত্রহারা: আলু-চাষি ব্রজেশের বাবা সত্যরাম যাদব। নিজস্ব চিত্র

পুত্রহারা: আলু-চাষি ব্রজেশের বাবা সত্যরাম যাদব। নিজস্ব চিত্র

অগ্নি রায়
কনৌজ শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৫০
Share: Save:

সিয়ারমাও গাঁয়ে ঢোকার আগে প্রশ্নটা করেছিলেন সম্মান সিংহ। কনৌজে সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তিনি। বলেছিলেন, ‘‘তিন কিলোমিটার অন্তর ঠেকা (দেশি মদের দোকান) খুলে রাখতে পেরেছে সরকার। বদলে সরকার নিয়ন্ত্রিত মান্ডি কি খুলে রাখা যেত না পরপর? যেখানে ন্যায্য দামে স্থানীয় চাষিরা সরাসরি ফসল বেচতে পারতো।’’

গ্রামের ফিসফাস— এলাকায় এজেন্টদের এত বাড়বাড়ন্ত কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের জন্যই। যে সব চাষি গাড়ি ভাড়া করে দূরে গিয়ে স্টোরেজে আলু বেচতে চান, তাদের নানাভাবে লুট করা হয়। কখনও গায়ের জোরে, কখনও মদ খাইয়ে! স্থানীয় কৃষক বেদরাম যাদবের দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি এখনও পর্যন্ত। তিনি জানালেন, সুভাষচন্দ্র পালের সুইসাইড নোটে সম্বোধন করা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথ এবং স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকেও। তা দেখে স্থানীয় গুরসহায় থানার এসএইচও নাকি ভুরু নাচিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা নিশ্চয় এরপর মোদীজি, যোগীজির কাছেও এই অভিযোগ নিয়ে যাবে! তাঁরা কী বললেন, সেটা আমায় জানিয়ো কিন্তু!’

সিয়ারমাও গাঁয়ের থেকে তিন কিলোমিটার দূরেই বেশ ছড়ানো শীতলা মন্দিরের চত্বর। অজ গাঁয়ে এই মন্দির চাতালের আয়তন দেখেই মালুম হল, এখানে সকাল-সন্ধ্যা শুধু পুণ্যার্থীরাই নন, নিছক গল্পগুজবের জন্যও ভিড় হয় ভালই। এক কথায়, এটি এই গাঁয়ের স্থানীয় সংবাদদাতাদের আপিস! স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় আত্মহত্যাটির সুলুক সন্ধান করব ভেবে এখানেই কিছুটা অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল, ঠিক যেন সুরে বাজছে না এই ঘাসিপূর্বা গ্রাম। চারদিক সুনসান। জানা গেল, নিত্য পূজারিও সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছেন উপাচারের সময়। এই বিহানবেলাতেই যেন রাত নেমে এসেছে গ্রামে।

আরও পড়ুন: ‘আমরা দশ দিন সময় চেয়েছিলাম, দু’দিনে করে দিয়েছি’

‘‘দবং (মস্তানি অর্থে) চলছে এখানে। বেশি খোঁজখবর নেবেন না। শহর থেকে এসেছেন, শহরেই চলে যান।’’ কণ্ঠস্বরে হুমকি না আতঙ্ক? পাকা রাস্তা থেকেই আমার সঙ্গ নিয়েছে রাম অবতার পাল নামের এক যুবক। কৃষক ব্রজেশ যাদবের আত্মহত্যার ঘটনার খোঁজ নিতে এসেছি শোনার পরে সে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নিমরাজি ভঙ্গিতেই।

হাঁটছে সন্তর্পণে। যেন সর্ষে আর আলু খেতের ফাঁকে মিইয়ে আসা আলোয় কোনও অদৃশ্য চোখ নজর রাখছে আমাদের উপর।

আরও পড়ুন: ‘আমার নাম হামিদ আনসারি...আমি চর নই’

‘‘আরে! আত্মহত্যা তো বাইরের লোকদের জন্য সাজানো। আপনারা শুনে গিয়ে ওটাই লিখবেন। ব্রজেশকে আসলে মেরে ফেলা হয়েছে মদে ওষুধ মিশিয়ে। তারপর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে গাছে।’’ রাম অবতারের কথা শুনতে শুনতেই যে কাঁচা বাড়ির দালানে এসে দাঁড়ালাম, সেখানে বাইরে কয়েকটা গরু আর ছাগল বাদ দিলে প্রাণের কোনও লক্ষণ চোখে পড়ছে না। তবে সামান্য সইয়ে নিতেই বুঝতে পারা গেল যে বেশ কয়েকজন আড়ালআবডাল থেকে উঁকি মারছেন। শীতকালে সন্ধ্যা বড় তাড়াতাড়ি নামে। বিশেষ করে গ্রামে। দ্রুত ‘ঝামেলা’ সারতে চাইছে রাম অবতারও। অনেক হাঁকডাক করে যাঁকে বাড়ি থেকে বের করে আনল, তাঁর বয়স বোধহয় সামনের অশ্বত্থ গাছটারই সমান। লাঠি হাতে কোনও মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে বসলেন সামনের চৌকিতে। বিড়বিড় করে কাকে গালি দিলেন বোঝা মুশকিল। ইনি সদ্য মৃতের বাবা সত্যরাম যাদব। বিড়বিড় ধ্বনি একটু স্পষ্ট হল। ‘‘দবং চলছে, দবং! নানহে পহলওয়ান কাউকে ছাড়বে না। আমরা বেশি কথা বলতে পারব না, আপনি চলে যান। ওর লোক সবদিকে লক্ষ্য রাখছে। বিপদে ফেলবেন না।’’ খনখনে গলায় দেহাতি উচ্চারণ।

ক্রমশ জানা গেল, এই গাঁয়ের স্থানীয় কৃষকদের সাম্প্রতিক ত্রাসের নাম নানহে। ২০১৪ সালে ফিরোজাবাদগামী আলুবোঝাই একটি ট্রাকের ড্রাইভারের গলা ক্ষুর দিয়ে আড়াআড়ি টেনে যার বায়োডেটা শুরু। অভিযোগ, গত সপ্তাহে ব্রজেশকে খেত-ফিরতি এজেন্টের মাধ্যমে পাকড়াও করে নানহে। ‘‘পুরনো কোনও রাগারাগি কিন্তু ছিল না। কী যে হয়েছিল সেদিন, আজও রহস্য।’’ বললেন সত্যরামের ভাতিজা। তিনিও সেদিন সঙ্গে ছিলেন ব্রজেশের। ৭৩টি প্যাকেট (এখানকার গোদা হিসাব প্রতি প্যাকেটে ৫০ কিলো আলু) পহলওয়ানের কাছে গচ্ছিত করার পর তাকে টেনে মদের আসরে বসায় শাগরেদরা। ফাঁক বুঝে চলে এসেছিল ভাতিজা। পরের দিন ব্রজেশ ফেরেন খালি হাতে। বলেন, দরে পোষায়নি বলে শুধু মদ খাইয়েই বিশ হাজার টাকার প্যাকেট হস্তগত করছে পহলওয়ানের দলবল। সঙ্গে প্রতিশ্রুতি— যথাসময়ে দাম দেওয়া হবে। বাড়ির গঞ্জনা শুনে তিনি ফের যান টাকা আদায় করতে। তারপর তাঁর ঝুলে থাকা দেহকে শনাক্ত করে গাঁয়ের মানুষ। নাহ্, কোনও নোট পাওয়া যায়নি।

শীত এবং রাত দু’টোই বাড়ছে। এক্সপ্রেসওয়ের মুখ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে গেল রাম অবতার। ওই গ্রামগুলির থেকে কিলোমিটারের হিসাবে কতটাই বা দূর এই মখমলের মতো ‘স্টেট অব দ্য আর্ট’ মহাসড়ক? আর দূরত্ব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Death Murder Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE