চন্দ্রিকা প্রসাদ রায় ও তেজপ্রতাপ
শোন নদী পার হতেই বড় সাইনবোর্ড, ‘স্বাগত, সারণ জিলা প্রশাসন’। শোনপুর পার হয়ে হাজীপুর-ছপরা রোড ধরে গাড়ি ছুটছে। দুপাশে চোখ ঘুরছে। ভোটের কপি খুঁজছে। কপি কই! রাস্তার দু’পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠের রং সবুজ নয়, পাকা গমের লালচে সোনালি। এখনও ফসল কাটা শুরু হয়নি।
কিন্তু ভোট? সামনেই কোনও জনপদ আসছে। জায়গার নাম শেখ ডুমরি। হঠাৎ চোখে পড়ল, ইটের দেওয়ালে সাদার লিখন। যাক, দেওয়াল লিখন শুরু হয়েছে! মুহূর্তেই অবশ্য সতর্ক। ১৯৮৯ সালে হরিয়ানার ভিওয়ানিতে বংশীলালের ভোট কভার করতে গিয়ে চোখ ডাহা ঠকে গিয়েছিল। হ্যাঁ, এ বারও ঠকল। সে বার রাজীব কুমার। এ বার ইমরান। রাজীব কুমারের নামের আগে ছিল ‘ডাঃ’, এঁর নামের আগে ‘বৈদ্য’। তাঁর নামের শেষে ছিল ‘সেক্সোলজিস্ট’, আর এঁর নামের আগে-পরে কমজোরি জাতীয় যাবতীয় বিশেষণ। পরের ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে অসংখ্য দেওয়াল, আর সর্বত্রই বৈদ্য ইমরান-ই জ্বলজ্বল করছেন। ভোট কোথাও নেই!
দেওয়াল ছেড়ে এ বার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির চোখ খোঁজে ফ্লেক্স, কাট আউট। অসংখ্য। কিন্তু সেখানে কোথাও নেই বিজেপি প্রার্থী, সারণের বর্তমান সাংসদ রাজীব প্রতাপ রুডি বা লালুপ্রসাদের বেয়াই (জামাই তেজপ্রতাপ অবশ্য তাঁকে শ্বশুর হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন না) চন্দ্রিকা প্রসাদ রায়। এই ফ্লেক্স, কাট আউটে জ্বলজ্বল করছেন ডঃ দীনেশ সিংহ, ডঃ সঞ্জয় শর্মা, অঞ্জনী কুমারেরা। ছপরার মানুষ, বিশেষ করে জেন-ওয়াই প্রজন্ম রাজস্থানের কোটার সঙ্গে তুলনা করেন সারণ তথা ছপরাকে। এঁরা সকলেই শিক্ষাবিদ। বিহারের ছেলেমেয়েদের নিট, এমস, আইআইটি, ক্ল্যাট, ক্যাট—যাবতীয় প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি করাই এঁদের ব্রত। তারই নানা বিশদ তথ্য, ফ্যাকাল্টি সদস্যদের ছবি ইত্যাদি রয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন, হোর্ডিং-এ। তা হলে ভোট কোথায়!
দশ বছর আগে সারণের জন্ম। তার আগে ছিল ছপরা লোকসভা আসন। ‘জিলাও ছপরা’। জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্মভূমি। জেপি’র আন্দোলন থেকে উঠে আসা লালুপ্রসাদ, নীতীশ কুমার, সুশীল মোদীরাই বিহার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ১৯৭৭ সালে লালুপ্রসাদ প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন এখান থেকেই। তারপরে ১৯৮৯, ২০০৪ ও ২০০৯—মোট চার বারের সাংসদ লালু। ২০১৪ সালের মোদী-জোয়ারে সারণ ধরে রাখতে পারেননি লালু-ঘরনি রাবড়ী দেবী।
সারণের বর্তমান সাংসদ বিজেপির রাজীবপ্রতাপ রুডি। জাতে রাজপুত রুডি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও। ১৯৯৬, ১৯৯৯-এও তিনি তৎকালীন ছপরা, অধুনা সারণ থেকে নির্বাচিত হন। লালুর গড়ে সেই রুডির সঙ্গে লড়ছেন চন্দ্রিকা। এখানকার মানুষ বলেন, চন্দ্রিকাবাবু। তাঁর বাবা দারোগাপ্রসাদ রায় অল্প সময়ের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। চপরা শহরে একটি চৌমাথার নাম ‘দারোগাপ্রসাদ চক’। শিক্ষিত যাদব পরিবার। সব দিক ভেবেচিন্তেই লালু বড় ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। রায় পরিবারও লালুপ্রসাদের ‘সম্বন্ধী’ হওয়ার সুযোগ ছাড়েননি। লোকে বলে, ছেলে দেখে নয়, পরিবার দেখেই উচ্চশিক্ষিত মেয়ে ঐশ্বর্যের বিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রিকা। এখন মনোকষ্টে ভুগছেন। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে ডিভোর্সের মামলা করেছেল তেজপ্রতাপ। বাবার গড়ে শ্বশুরকে টিকিট দেওয়ায় ক্ষিপ্ত জামাই। সারণ লোকসভা আসনে নিজেই মনোনয়ন জমা করতে পারেন বলেও ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন।
ছপরার আরজেডি (বিহারে বলে ‘রাজদ’)অফিসে বসে এক প্রবীণ লালু-অনুগামী, ব্রজেশ্বর রায় বলছিলেন, ‘‘উল্টা শর্ হো গিয়া।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এখানে মনোনয়ন জমা দিতে এলে লালু-অনুগামীদের হাতে তেজপ্রতাপ মারও খেয়ে যেতে পারেন।’’ পাশে বসা আর এক প্রবীণ যাদব-কর্তার বক্তব্য, ছেলেপিলে মানুষ করতে হলে শাসন দরকার।
কী হবে ভোটে? লালু-অনুগামীদের কথায়, ছপরার যা কিছু উন্নয়ন লালুর আমলেই হয়েছে। রেলমন্ত্রী লালু ছপরায় রেলের চাকা তৈরির কারখানা গড়েছিলেন। রাস্তা-ঘাট যা সবই নাকি লালুজির দান।
কিন্তু রাস্তার হাল তো খুব খারাপ। পটনা-ছপরা ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কে অন্ধকার নামলে গাড়ি চালানোই বিপজ্জনক। ২০১০ থেকে কাজ চলছে। ২০১৪য় সম্প্রসারণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২০১৯-এও কাজ চলছে। দিগওয়াড়ার কুশওয়াহা টেন্ট এজেন্সির দোকানে বসে কথা হচ্ছিল হরি সিংহ কুশওয়াহার সঙ্গে। তিনি এর জন্য কাঠগড়ায় তুললেন বর্তমান সাংসদ রাজীবপ্রতাপ রুডিকেই। রুডির বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ, ভোটের সময় ছাড়া সাধারণ মানুষ তাঁর দেখা পান না। লোকে রুডিকে বলেন ‘হাওয়া হাওয়াই’। অভিজাত, শিক্ষিত রুডি কখনও সখনও আসেন। পার্টি অফিসের ধার ধারেন না। এলাকার অভিজাত কিছু মানুষের সঙ্গেই তাঁর ওঠাবসা।
এ বারের ভোটে রুডির বিরুদ্ধে আর একটি ‘জ্বলন্ত ইস্যু’ বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারী বাহন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০১৬র অক্টোবরে এই কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় সড়ক নির্মাণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। দেড়-দু’মাসের প্রশিক্ষণের পর চাকরি। এলাকার গরিব যুবকদের আশার আলো ছিল এই কেন্দ্র। কয়েক মাস আগে কোনও এক অজানা কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রটি। স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালেখি হলেও লাভ হয়নি। ডোরিগঞ্জের যুবক রঞ্জন কুমার এই কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও চাকরিবাকরি পাননি। রাগী যুবকের কথায়, ‘‘ঠগী হুয়ি হমারে সাথ।’’
ভোটের বিষয় কী ছপরায়? আরজেডি নেতাদের কথায়, প্রচারে তাঁরা ছপরার অনুন্নয়ন ও উন্নয়নেই জোর দেবেন। আর বিজেপি অফিসে বসে স্থানীয় নেতা বোঝান, ‘‘লোকসভা ভোট অনেক বৃহত্তর ব্যাপার। এ বারের ভোট হবে নরেন্দ্র মোদীজিকে সরকারে ফেরানোর ভোট। প্রচারের হাতিয়ার দেশপ্রেম।’’ বিজেপি নেতৃত্ব সেই চেষ্টাই করছেন। উন্নয়ন-অনুন্নয়নের চক্করে পড়তে চাইছে না তারা। মোদী না থাকলে পাকিস্তান ভারতের দখল নেবে—এই প্রচ্ছন্ন প্রচার গত কয়েক মাসেই ছড়িয়ে গিয়েছে একটা বড় অংশের মনে। সেখানে বিহারের জাতপাতের অঙ্কও সব সময় কাজ করছে না। বিশেষ করে নব্য ভোটারদের ভিতরে, সে তিনি যাদবই হন বা দলিত, ব্রাহ্মণ কিংবা রাজপুত।
চন্দ্রিকাবাবুর চিন্তা এখানেই। লালু-হীন এই ভোট-যজ্ঞে আরজেডি এখনও অগোছালো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy