Advertisement
E-Paper

ঘরে অসুস্থ মা ও বাবা, কণ্ঠে আশা-লতা, টিমটিম করে চলছে মুম্বইয়ের ডান্সবার

ওরলির এই অভিজাত পাড়ায় আলোর ঔজ্জ্বল্য বাড়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে যে উৎসব মুখরতার জন্য শুধু ওরলি নয়, ভাসি থেকে অন্ধেরি— গোটা মুম্বইয়ের নিশিযাপন দেশে প্রসিদ্ধ ছিল, তা আর নিরবচ্ছিন্ন নয়।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:১৩
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সাজঘরের খোলা আলমারিতে ঝোলানো বিবর্ণ সালোয়ারগুলো। মাটিতে ক্ষয়ে আসা পথক্লান্ত জুতো। টেবিলে রাখা তিন-চারটে মেক-আপ বক্স। বক্সে আলাদিনের প্রদীপ— গভীর রাতের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য আত্মবিশ্বাস জোগায়। চড়া মেক-আপ আর মঞ্চে ওঠার আগে পরে নেওয়া ফ্যাশন দুরস্ত ঘাগরা-চোলির পিছনে লুকিয়ে থাকে দিনের হাজারো রক্তক্ষরণ সামলে রাত জাগার ক্লান্তি।

ওরলির এই অভিজাত পাড়ায় আলোর ঔজ্জ্বল্য বাড়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে যে উৎসব মুখরতার জন্য শুধু ওরলি নয়, ভাসি থেকে অন্ধেরি— গোটা মুম্বইয়ের নিশিযাপন দেশে প্রসিদ্ধ ছিল, তা আর নিরবচ্ছিন্ন নয়। পুলিশের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে, আদালতের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলতে খেলতে টিমটিম করে চলছে মুম্বইয়ের ডান্স বারগুলি। অর্ধেকের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেগুলি লড়ে জমি ধরে রেখেছে, তাদের নাম বদল করে রাখতে হয়েছে ‘নাইট অর্কেস্ট্রা’। নাচ বন্ধ, রাতে খোলা রাখার সময়সীমাও সংক্ষিপ্ত। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর সম্প্রতি ডান্স বার ফের খোলার রায় সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও লাইসেন্স দেওয়ার প্রশ্নে হাজারো নিষেধ তৈরি করে রেখেছে এখানকার বিজেপি সরকার।

“এ ভাবে কত দিন টানতে পারব জানি না। রোজগার বহু কমেছে। অসুস্থ বাবা মা-সহ বাড়িতে পাঁচ জনের জীবন চলে আমার টাকায়। আছে একটা বাচ্চাও। লোকে তো শুধু মহারাষ্ট্রে কৃষক আত্মহত্যার কথাই জানে। আপনি জানেন, এক বছরে অন্তত চার জন ডান্স গার্ল আত্মহত্যা করেছে দারিদ্রের তাড়নায়? অন্য সহজ পথে টাকা কামানোর তুলনায় গলায় দড়ি দেওয়াটাই ভাল মনে করেছে, তাই চলে গিয়েছে।” একটু আগে স্টেজ দাপিয়ে যিনি গাইছিলেন ‘হোঁঠো পে অ্যায়সি বাত..’ তিনি এখন মুখোমুখি সোফার সামনে। ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁতে চলেছে। নিকটবর্তী ধারাভিতে থাকেন এই গীতাঞ্জলি আজগাঁওকর (নাম পরিবর্তিত)। বয়সকালের মীনাকুমারীর মতো চেহারা, অর্থাভাব যাতে বিষাদ যোগ করেছে। “এখানে রোজগার কমায় অন্য চেষ্টা করেছিলাম। পারলাম না। লেখাপড়া বেশি শিখিনি। পার্লারে গিয়েছিলাম। আমি বার-এ নাচি চাউর হওয়ায় কেউ শান্তিতে কাজ করতে দিল না।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আদালত এবং পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সেই স্পর্শকাতর সময়ে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলার প্রশ্নে বার মালিক এবং নর্তকী গায়িকারা যে কঠিন দেওয়াল তুলে দিয়েছেন, সেটা মুম্বইয়ে পা দেওয়ার আগেই বোঝা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ‘আহার’ (মুম্বইয়ের সমস্ত হোটেল-রেস্তরাঁ-বার-এর সংগঠন। লড়াইয়ের জন্য যার ছাতার তলায় এসেছে মুম্বই ডান্স বার কমিটিও)-এর অনুগ্রহে রাতের অর্কেস্ট্রায় ইন্টারভিউ-এর অনুমতি মিলেছে। কিছু আবশ্যিক বিধিনিষেধ-সহ।

“যে সরকারই আসুক, আমাদের কামাইয়ের রাস্তা যেন বন্ধ না করে দেয়। গত পাঁচ বছরে লোক আসা আরও কমে গিয়েছে পুলিশের উৎপাতে”, বলছেন মঞ্জু ভোগালে (পরিবর্তিত)। ছুটির দিন বাদে প্রায় খালি দর্শকাসনের সামনে প্রতি রাতে যিনি কখনও লতা কখনও আশা, বা শ্রেয়া ঘোষাল। অসুস্থ বাপ-মা-ভাইবোনের পাশাপাশি যাঁকে টানতে হয় মানসিক রোগে আক্রান্ত বেরোজগার দাদার পরিবারও। “লোকে জুনা গান (পুরনো গান) শুনতে পছন্দ করে। এটাই আমাদের যা হোক করে বাঁচিয়ে রেখেছে।” টিভি দেখে নাচ শিখেছিলেন মঞ্জু, আর নিজে থেকেই গান। ২০০৫-এ তৎকালীন এনসিপি-কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পটেলের উদ্যোগে ডান্স বার বন্ধ করার যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, তা গতি পায় গত বিজেপি জমানায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আহার-এর এক কর্তার কথায়, “বার-এ মদ্যপান, মেয়েদের নাচ— এর পিছনে জনআবেগ বা সমর্থন নেই কোনও কালেই। যাঁরা রাতে গান বা নাচ দেখতে আসেন তাঁরাই দিনের বেলায় ঘোর বিরোধিতা করছেন। এর মধ্যে পুলিশ কর্তা, উকিলও রয়েছেন। মুম্বইয়ের ধর্মই হল, রাতের কথা কেউ দিনে মনে রাখে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সাফ বলেছে যে রোজগারের অধিকার কেউ বন্ধ করতে পারে না।”

বিজেপি-শিবসেনা সরকার আসার পর যে সব শর্ত চাপানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বার-এ চারজনের বেশি গায়িকা থাকা চলবে না, পাঁচ ফুট রেলিং থাকবে মঞ্চে, এক কিলোমিটারের মধ্যে মন্দির থাকা চলবে না! গীতাঞ্জলির কথায়, “শুরু হয়েছে পুলিশের পরীক্ষা নেওয়া! সর্বত্র সিসি-ক্যামেরা বসাতে বলছে। মাঝেমধ্যেই হানা দিচ্ছে ভিতরে! আমাদের গেয়ে শোনাতে বলছে এটা পরখ করার জন্য যে কী উদ্দেশে এসেছি। এটা বুঝছে না, অন্য পথে টাকা কামাতে হলে কষ্ট করে গান গাইতে আসতাম না।”

মেক আপে ফের একবার মুখ ঢেকে, সবুজ-নীল-মেরুন আলোর বৃত্তের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন ওঁরা। পিছনে অর্কেস্ট্রা। এক টুকরো এই ভারতকে পিছনে রেখে দরজা বন্ধ করার সময় শুনলাম, গান্ধার নিষাদ পঞ্চমে গলা খেলছে ওঁদের।

‘…বড়ি দূর নজর আয়ে..।’

Lok Sabha Election 2019 Mumbai Mumbai Dance Bar লোকসভা ভোট ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy