Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মূর্তির ছায়ায় কি গ্রহণ গ্রামে

মাটি ফুঁড়ে প্রথমেই যিনি সামনে এলেন, তিনি এক খর্বকায় ব্যক্তি। কিছুটা যেন কেষ্ট মুখার্জির মতো হাবভাব (একটু পরেই বোঝা গেল, সুরানিষিদ্ধ এই গুজরাতের গ্রামে ভর গ্রীষ্ম দুপুরে এই ব্যক্তি বিশুদ্ধ তাড়ির নিজস্ব বন্দোবস্ত সেরে ফেলেছেন!)।

স্ট্যাচু অব ইউনিটি।

স্ট্যাচু অব ইউনিটি।

অগ্নি রায়
নর্মদা (গুজরাত) শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪২
Share: Save:

‘সার্ভেওয়ালো আভো ছে! সার্ভেওয়ালো আভি গায়ো ছে!’

কাঁটা ঝোপ, মাটির কুঁড়ের ফাঁকে ফোঁকরে হইচই পড়ে গেল যেন। নর্মদা জেলার লিমড়ি গ্রামের ভিতর ঢুকে এসেছি যত দূর পর্যন্ত মোটরগাড়ির পথ। একটি পাতাও তো নড়ছিল না। নোটবুক, পেন হাতে নেমে গুজরাতি চালককে সঙ্গে নিয়ে একটু হেঁটে একটি-দু’টি বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারতেই পুকুরে ঢিল পড়ার এফেক্ট। বোঝা গেল, সাংবাদিকের সঙ্গে সর্দার সরোবর নর্মদা নিগমের সার্ভে অফিসারকে গুলিয়ে ফেলেছে এই প্রত্যন্ত গ্রাম!

মাটি ফুঁড়ে প্রথমেই যিনি সামনে এলেন, তিনি এক খর্বকায় ব্যক্তি। কিছুটা যেন কেষ্ট মুখার্জির মতো হাবভাব (একটু পরেই বোঝা গেল, সুরানিষিদ্ধ এই গুজরাতের গ্রামে ভর গ্রীষ্ম দুপুরে এই ব্যক্তি বিশুদ্ধ তাড়ির নিজস্ব বন্দোবস্ত সেরে ফেলেছেন!)। কিন্তু বিস্ময়কর এই যে, চরিত্রটি যখন গলা খুললেন, রীতিমতো ব্যারিটোন আওয়াজ! “সার্ভেওয়ালা হও বা নিগমের লোক। মোদীকে বলে দাও এক ছটাক জমিও আর দেবো না। পারলে আমাদের লাশের উপর সাফারি পার্ক বানাক।”

অল্প দূরেই সর্দার সরোবর বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অতিকায় সর্দার বল্লভভাই পটেল। তাঁর ছায়ায় ঢেকে যাওয়া নর্মদা জেলার গ্রামগুলির মনের কথা শুনতেই কেবাড়িয়া, রাজপিপলি হয়ে এই লিমড়িতে। সর্দারের মূর্তি ঘিরে যে মেগা পর্যটন পরিকল্পনা, তার অংশ হিসাবে ভাবা হয়েছে বিশাল টাইগার সাফারি করার কথা। প্রয়োজন ২০০ একর জমি। নির্ধারিত নকশার মধ্যে পড়ছে আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের মধ্যে এই লিমড়িও। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সরকারি সার্ভেওয়ালারা হানা দিচ্ছে এখানকার ৫০-৬০টি গ্রামে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পত্রকার বুঝতে পারার পর গাছ থেকে তাল পাড়া হল। ক্রমশ জানা গেল এই ‘কেষ্ট মুখার্জি’র নাম জুকাভাই তারবে। কিছু দূর অবধি পড়াশুনো করেছেন। সামান্য জমি সম্বল, যেখানে বাজরা, মক্কার চাষ করে কোনও মতে পেট চলে। “এ বার যদি তাতেও লাথি মারে, কী করে হবে বলুন তো। বিকাশ হচ্ছে বলে খুব শুনি এখানকার শহুরে বাবু আর ভোটবাবুদের মুখে। সে হোক। কিন্তু আমাদেরও রাখতে হবে বিকাশের চৌকিদার হিসাবে। এখান থেকে জমি নিয়ে ৬০ কিলোমিটার দূরে জমি দেবে, কি দেবে না তার ঠিক নেই। দিলেও হয়তো ফসল হবে না।”

আসার পথে ঠিক এ রকমই ঘটনা দেখে এই লিমড়িতে এলাম। সুরাত থেকেই লক্ষ্মণ ভাইয়ের নম্বর জোগাড় করে এখানে আসা। নর্মদার স্থানীয় জমি বাঁচাও অধিকার কমিটির সর্বেসর্বা এই অদ্ভূত মানুষটি বিরাট শোলার টুপি আর ঢিলে জামা পায়জামা পরে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে এই তীব্র রৌদ্রে ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। দু’বার তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে নিগমের লোক জন। এক বার হাজতবাসও করতে হয়েছে। মেধা পটেকর নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এই লক্ষ্মণ ভাইয়ের সঙ্গে। বহু চেষ্টার পর তাঁর দেখা মিলল কেওড়িয়া গ্রামের পাশে বিশ-একর জমির উপর তৈরি হওয়া মেগা সরকারি গেস্ট হাউস ভারত ভবনের সামনে। যাঁরা সর্দারের মুর্তি দেখতে আসবেন, তাঁরা এই বিলাসবহুল কমপ্লেক্সটিতে থাকবেন। পাশেই সাত একরের পার্কিং লটটি তৈরি হয়ে গিয়েছে। “যাদের জমি-বাড়ির উপরে এই পার্কিং লট আর ভবন তৈরি হয়েছে তাদের দেখতে পাচ্ছেন তো? ছোট ছোট ফলমূলের দোকান সাজিয়ে বসে আছে। যাবজ্জীবনের ভিটে কেড়ে বহু দূরে যে জমি ওদের দিয়েছে তা চাষের অযোগ্য। তা-ও হাতে জমির দস্তাবেজ পায়নি।” একটানে কথাগুলো বলে গেলেন লক্ষ্মণ ভাই। “এখন এরা কেওড়িয়ারই অন্য প্রান্তে কোনও মতে রয়েছে। এখানে অস্থায়ী দোকান দিয়েছে। সামনে ভোট তাই নিগমের লোকজন কিছু বলছে না। পরে এখানে সব বড় ব্র্যান্ড-বিপণি এসে গেলে এদের লাথি মারবে। আমার সঙ্গে কথা না বলে ওদের কাছেই জানতে চান।”

প্রাক্তন কৃষক এবং অধুনা অস্থায়ী দোকানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য লক্ষ্মণ ভাইয়ের কথারই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল। যাঁর সবচেয়ে বেশি জমি গিয়েছে, সেই গোবিন্দ মালাল তাড়বি জানালেন, এখানে শুধু এই তিন তারা গেস্ট হাউস নয়, সমস্ত রাজ্যের গেস্ট হাউস তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে জমি নিয়ে। কেবাড়িয়া গ্রামে যেটুক জমি বেঁচে রয়েছে, সেগুলিও আর নিরাপদ নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। ভারত ভবনের ঠিক উল্টোদিকেই আখের রস বিক্রি করেন মণীশ তান্নু। জমি বাঁচাও কমিটির একজন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীও বটে। সমস্ত খবরাখবর গ্রামগুলিতে আগাম দেওয়া তাঁর কাজ।

কিছু দিন আগেই হরিয়ানা ভবনের মাপজোক করতে পুলিশ নিয়ে এসেছিল নিগমবাহিনী। গ্রামবাসী পুলিশকে পাথর ছোড়ায় এলাকা গরম হয়ে রয়েছে। লখন ভাইয়ের মাধ্যমে যোগযোগ হওয়ায় মুখ খুললেন মণীশ। “এর আগে জমি দিয়েছি। আমার সার্ভে নম্বরও রয়েছে। নতুন জায়গায় জমির আশ্বাসমূলক কাগজ পেয়েছি এখনও পর্যন্ত। নিজের বাকি যেটুকু ছিল তাতে ডুংরি পেঁয়াজ, খাট্টি বেগুন, ভিন্ডি ফলাই। গত সপ্তাহে আমাদের না জানিয়ে সরকারি লোক এসে বলছে এখানে বোটিং স্টেশন হবে। পুলিশ পর্যন্ত বোঝাচ্ছে সেখানে নাকি কাজ পাব!”

যাকে এখনই পর্যটনের প্রশ্নে তাজমহলের সঙ্গে তুলনা করছে মোদী সরকার সেখানে নাকি ছুটির দিনে হাজার দেড়েক লোক হয়। প্রবল গরমে সেদিন অবশ্য ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ খাঁ খাঁ করছে। সুরাতের ফিরতি পথ ধরছি যখন বেলা পড়ে আসছে। দীর্ঘ হচ্ছে মূর্তির ছায়া। গ্রহণ লাগা গ্রামগুলিকে আরও ধূসর করে দিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE