Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘মু জানুচি’, নেতাদের বেফাঁস কথা ধরে ফেলেছিলেন নবীন

মুখ্যমন্ত্রিত্বের একেবারে গোড়ায়, যখন এতটা নিশ্চিত ছিলেন না, তখন ওড়িয়া শিখতে শুরু করেছিলেন নবীন। ২০০০-এর মার্চে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করল তাঁর দল।

রাজকিশোর মিশ্র। —নিজস্ব চিত্র।

রাজকিশোর মিশ্র। —নিজস্ব চিত্র।

সৈকত বসু
ভুবনেশ্বর শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:০৫
Share: Save:

ওড়িশাতেই তাঁর জন্ম। এখানেই কেটেছে তাঁর ছোটবেলা। রাজনীতি করছেন প্রায় ২২ বছর। তার মধ্যে ১৯ বছর মুখ্যমন্ত্রী। তবু ওড়িয়া ভাষাটা রপ্ত হল না নবীন পট্টনায়কের। জনসভায় বলতে উঠে এখনও কাগজ চেয়ে নেন। তাতে রোমান হরফে লেখা থাকে ওড়িয়া বক্তৃতা।

এ নিয়ে বিস্তর কটাক্ষ বিরোধীদের। এক সময় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি নবীন নিবাসের সামনে বিক্ষোভও দেখিয়েছে কংগ্রেস। চলতি ভোট মরসুমে রাজ্যে এসে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলে গিয়েছেন, “যিনি নিজেই ওড়িয়া জানেন না, তিনি ওড়িশার সমস্যার সমাধান করবেন কী করে!” বিজেডি নেতারা অবশ্য বলছেন, এ সব সমালোচনায় নবীনের কিছু যায় আসে না। কারণ, তিনি জানেন যে তাঁর স্থান ওড়িশাবাসীর হৃদয়ে।

মুখ্যমন্ত্রিত্বের একেবারে গোড়ায়, যখন এতটা নিশ্চিত ছিলেন না, তখন ওড়িয়া শিখতে শুরু করেছিলেন নবীন। ২০০০-এর মার্চে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করল তাঁর দল। পরের মাস থেকেই তাঁকে পড়াতে শুরু করলেন ভুবনেশ্বরের বিজু পট্টনায়ক কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ রাজকিশোর মিশ্র। নবীনের বাবা বিজু পট্টনায়কের সঙ্গে যাঁর সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আইআরসি ভিলেজের বাড়িতে বসে গোড়ায় মুখ খুলতে চাইছিলেন না রাজকিশোর। “এখন ভোটের সময়, কোন কথা থেকে কী বিতর্ক তৈরি হয়।” খানিক ক্ষণ পরেই অবশ্য দ্বিধাটা কাটিয়ে উঠলেন। বোঝা গেল, ছাত্র ‘অকৃতকার্য’ হলেও তাঁর প্রতি শিক্ষকের স্নেহ এখনও অটুট।

“ওড়িয়া না-জানা নিয়ে নবীনকে দোষ দেওয়াটা ঠিক নয়,” বলছেন রাজকিশোর। “নবীনের মা জ্ঞান পঞ্জাবি। ফলে সেই অর্থে ওড়িয়া ওঁর মাতৃভাষা নয়। তা ছাড়া, ছোটবেলায় যে গভর্নেসের কাছে উনি মানুষ, তিনি কথা বলতেন ইংরেজিতে। পরিচারকেরাও নবীনের সামনে হিন্দিতে কথা বলত। তার পর তো দুন স্কুল, সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ।”

২০০০-এর এপ্রিল-মে থেকে প্রায় দু’বছর নবীনকে ওড়িয়া শিখিয়েছেন রাজকিশোর। সকাল আটটার মধ্যে চলে যেতেন নবীন নিবাসে। প্রায় প্রতিদিন। কোনও দিন দু’ঘণ্টা, কোনও দিন তিন ঘণ্টা চলত পড়ানোর পালা। “শুধু ভাষা শিক্ষা নয়, আমার কাছ থেকে রাজ্যের সংস্কৃতি, ভূগোল, সামাজিক পরিস্থিতি—যাবতীয় বিষয়ে খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিতেন।” এক প্রায় অচেনা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে তখন তৈরি করছেন নবীন।

কিন্তু ভাষাজ্ঞানটা দু’বছরেও মোটেই পোক্ত হয়নি। “ইংরাজিতে ওড়িয়া উচ্চারণ বোঝাতাম ওঁকে। তার হ্যাপা বিস্তর। ইংরাজিতে ‘অ’ নেই। এডব্লিউই লিখে বোঝাতে হত। কোনও একটা শব্দ বললেই বলতেন, দাঁড়ান দাঁড়ান, আগে মাথায় বসিয়ে নিই,” বললেন রাজকিশোর। কিন্তু এত করেও ওড়িয়া অক্ষর বিশেষ চিনে উঠতে পারেননি নবীন। অন্তত সেই দু’বছরে। “এখন কী পারেন, কতটা পারেন বলতে পারব না, আমি যত দিন ছিলাম, তত দিন ওড়িয়া কিছুটা বুঝতে পারলেও বলা বা পড়াটা একেবারেই রপ্ত করতে পারেননি নবীন।”

তবে বোঝার ক্ষমতা দিয়েই মাঝেমধ্যে অপ্রস্তুতে ফেলে দিতেন দলের নেতাদের। এক দিন নবীনের সামনেই নেতারা ওড়িয়ায় বলাবলি করছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কোনও লাভ হয় না। যা বলি উনি তো কিছুই বোঝেন না। নবীন আচমকা বলে উঠলেন, “মু জানুচি” (আমি বুঝি)। “নেতাদের অবস্থা যদি তখন দেখতেন,” হো হো করে হেসে ওঠেন রাজকিশোর।

নবীনকে দিয়ে প্রথম ওড়িয়ার ভাষণ দেওয়ান রাজকিশোরই। “প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পারাদ্বীপে এলেন। আমি নবীনকে জোর করে বললাম, আপনি ওড়িয়ায় বক্তৃতা দিন। রোমান হরফে লিখে দিলাম বক্তৃতা। উনি বেশ কয়েক বার মহড়া দিয়ে নিয়ে তার পর সভায় পড়লেন। সবাই তো অবাক।” সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।

কিন্তু নবীনের মতো সংস্কৃতিমনস্ক, অন্য ভাষায় যথেষ্ট দখল থাকা এক জন মানুষ ওড়িয়াটা শিখে উঠতে পারলেন না কেন? রাজকিশোর বলছেন, “দেখুন, ভাষাশিক্ষার সব চেয়ে উপযুক্ত সময় হল ৭ থেকে ১২ বছর। সেই সময়টায় যে কেউ একাধিক ভাষা দ্রুত শিখে ফেলতে পারে। বয়স বেড়ে গেলে সেই ক্ষমতাটা বেশির ভাগ লোকেরই হারিয়ে যায়।” তখন দরকার কঠোর পরিশ্রম, বারবার অভ্যাসে রপ্ত করার চেষ্টা। কাজের চাপেই হোক, বা অন্য কারণে, ওড়িয়া শেখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন নবীন। “আমারও আর উৎসাহ ছিল না। এক দিন ওঁকে বললাম, এ ভাবে চলে কোনও লাভ নেই। যাওয়া বন্ধ করে দিলাম

নবীন নিবাসে।”

দু’বছরের শিক্ষকতার দক্ষিণা? “টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না,” বললেন রাজকিশোর। নবীনও সেটা জানতেন। তাই কখনও কিছু বলেননি। দুই মেয়ের বিয়েতে এসেছেন, এমনকি, রাজকিশোর পড়ানো ছেড়ে দেওয়ার পরেও। উপহার দিয়েছেন গীতা। তার পর আর যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন।

ছাত্র হিসেবে ব্যবহার কেমন ছিল নবীনের? হাজার হোক মুখ্যমন্ত্রী বলে কথা! রাজকিশোর বলেন, “একটা উদাহরণ দিই, তা হলে বুঝতে পারবেন। এক বার পড়ানোর সময় উনি সিগারেট ধরালেন। আমি বললাম, ছাত্র শিক্ষকের সামনে ধূমপান করবে, এটা ভারতীয় সংস্কৃতির রীতিবিরুদ্ধ। তক্ষনই নিভিয়ে ফেললেন। তার পর থেকে আর কোনও দিন আমার সামনে সিগারেট খাননি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE