Advertisement
E-Paper

উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজলে রক্তপাত থামবে না

‘এত রক্ত কেন?’ সে প্রশ্নেই গোবিন্দমাণিক্য তাঁর দায় শেষ হয়েছে বলে মনে করেননি। তিনি রক্তপাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজা অবিচল ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে। সুতরাং, সাধারণ মানুষও যেন নিজের কর্তব্য না ভোলেন।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ১২:৪৯
ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে মহিলা ভোটারদের লাইন। —ফাইল চিত্র।

ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে মহিলা ভোটারদের লাইন। —ফাইল চিত্র।

দেয়ালে চোখ ফেললে এখন শুধুই ভোট-প্রার্থীর নাম। বাজারে গেলে ভোটের সম্ভাব্য ফল নিয়ে নানা মতামত। তা ঘর-সংসারেও ভোট ঢুকে পড়েছে। ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় এখন শত রকমের মন্তব্য নেতা-নেত্রীদের নিয়ে। ভোটের চেয়ে বড় কোন‌ও খবর এখন দেশে নেই। খবরের কাগজ ও টিভিতে দেখি, ভোটকর্মীরা কেউ পাহাড়ি পথ ভাঙছেন, কেউ চলেছেন মরুভূমি পেরিয়ে। দ্বীপ থেকে অরণ্য পর্যন্ত‍ ভোটের আয়োজন। এ যেন গণতন্ত্রের মহোৎসব। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় নির্বাচন। শুধু জনসংখ্যার হিসেবে নয়, জনসচেতনার নিরিখেও বিস্ময়ের।

কিন্তু এর পাশাপাশি, এই নির্বাচনকে ঘিরে হিংসার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কয়েকদিন আগে দিল্লিতে মহিলারা মিছিল করেছেন আত‌ঙ্কমুক্ত নির্বাচনের জন্য। তাঁরা দাবি তুলেছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের। নির্বিঘ্নে শুধু নিজের ভোটদান নয়, তার চেয়ে বড় এক দাবি ছিল সে সমাবেশের। তাঁরা চেয়েছেন, সমগ্র নির্বাচন পর্বটি যেন রক্তপাত ও মৃত্যুহীন হয়। ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ পর্বে নারীর এই স্বর শোনা যায়। এই কথাগুলিই দূর অতীতে গান্ধারি ও কুন্তি শোনাতে চেয়েছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের। বিশ শতকের প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথের আনন্দময়ী বোঝাতে চেয়েছিলেন গোরাকে আর মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা শোনাতে চেয়েছিলেন সত্তরের দশকের যুবকদের। গান্ধারি, কুন্তি, আনন্দময়ী, হাজার চুরাশির মা আর দিল্লির ওই মহিলারা যেন এক‌ই সূত্রে বাঁধা। হিংসা, রক্তপাত ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে জাগ্রত নারীকণ্ঠ।

নির্বাচনকে ঘিরে যে হিংসার আশঙ্কা দিল্লিতে, তার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। নিরাপত্তার দাবিতে ভোটকর্মীরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। তাঁদের হাতে চোখে পড়েছে ‘রাজকুমার রাও (ভোট বিষয়ক নিউটন ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র) হতে চাই না’-র মতো ফেস্টুন‌। নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তখন সত্যিই ভাবতে হয়। বাড়ি ছেড়ে যাঁরা নির্বাচনের কাজে চলেছেন তাঁরা তো কাজের সুস্থ পরিবেশ চাইবেন‌ই।

শুধু দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, হিংসার আশঙ্কা রয়েছে দেশের অন্যত্রও। ১৭তম সাধারণ নির্বাচনে অশান্তির সম্ভাবনার কথা কয়েকমাস আগেই শুনিয়েছেন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার টি এস কৃষ্ণমূর্তি। আগুনের যেমন ইন্ধন লাগে, হিংসার‌ও তেমন জোগান লাগে। অর্থ ও ঘৃণা হল হিংসার দু’টি উৎকৃষ্ট ভোজ্য বস্তু। অর্থ ছাড়া এক জন কেন‌ই বা অস্ত্র ধরবে, আর সে অস্ত্র‌ই বা হাতে আসবে কেমন করে? ভোটকেন্দ্রের বিকল্প যখন বাহুবলীর বন্দুকের বুলেট, গণতন্ত্রের সে বড় বিপর্যয়ের কাল।

কিন্তু বাহুবলীরা এতখানি বল কেমন করে অর্জন করে রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া! এই অস্ত্রধারী লোকজন পরজীবী লতার মতো, যারা কোন‌ও গাছের অবলম্বন ছাড়া বাঁচতে পারে না। খণ্ড ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক উপার্জনের প্রয়োজনে এদের সময়ে সময়ে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাহুবলের উপরে ভর করে কেউ রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার পায় না। তাকে এই দেশে মুখ্যত জনসমর্থনের উপরে নির্ভর করতে হয়। দুর্ভাগ্য হল, মানুষের সমর্থনে যে জয়‌ তার‌ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায় অন্যত্র বাহুবলীদের তাণ্ডবে। নির্বাচনে দু-চারটে আসন হারানোর চেয়ে তা আর‌ও বড় হার। মানুষের সামগ্রিক বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা। তাই হিংসা থেকে সরে না এলে, প্রতিহিংসার জন্ম রোখা যাবে না। তখন সেই আগুনে পুড়তে হবে। সেই আগুনের তাপে পুড়বে আশপাশের সাধারণ মানুষ। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলির‌ই দায়িত্ব এই নির্বাচনকে শঙ্কাহীন করার।

নির্বাচন যাঁরা পরিচালনা করছেন তাঁদেরও বড় দায় রয়েছে এ বিষয়ে। মানুষ কিন্তু তাঁদের ভরসাতেই ভোট দিতে যান। নির্বাচকেরা যাতে তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে দায়িত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ার স‌ঙ্গে যুক্ত মানুষদের‌ই নিতে হবে। তাঁদের স্মরণে রাখতে হবে যে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি—মানুষের দেওয়া এই ভোট। ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল ভিতরের আঘাত। এ আঘাত গণতন্ত্রের ভিত্তিতে, জাতির প্রাণসত্তায়। সে আঘাত সামলানোর দায়িত্ব নির্বাচন পরিচালকদের‌ই। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের উপরে, তাঁদের এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কেন মানুষ এই নির্বাচনকে ঘিরে শঙ্কিত, তা তাঁদের ভাবার প্রয়োজন আছে। শুনেছি, সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত আনুগত্য দেশের পতাকার প্রতি। তেমন ভাবে এই সাধারণ নির্বাচনের প্রতি আরক্ষাবাহিনী আনুগত্য জানাতে পারে না? নির্বাচন একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। তা পালনের চেয়ে আর কী বড় দায়িত্ব থাকতে পারে!

ভোটদাতা হিসেবে আমাদের‌ও দায়িত্ব থাকে। সাড়ম্বরে বিদ্যাসাগরের জন্মের দু’শো বছর পালন করি আমরা। পালন করি বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ। রানি রাসমণির জীবনকাহিনি নিয়ে তৈরি বাংলা ‘সিরিয়াল’ও বেশ জনপ্রিয় বলে শুনেছি। এঁরা সবাই প্রবল বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে কাজ করেছেন। তবে আমরা কেন পারব না! মানুষ প্রতিরোধ গড়লে গণতন্ত্রের শত্রুরা পালায়। মা যেমন তার সন্তানকে রক্ষা করে, কৃষক যেমন তার ধান রক্ষা করে, তেমন ভাবেই গণতন্ত্রকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।

অপর্ণার ছাগশিশুটির রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল মহামায়া মন্দিরের সিঁড়ি। রাজা গোবিন্দমাণিক্যের মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, ‘এত রক্ত কেন?’ সে প্রশ্নেই গোবিন্দমাণিক্য তাঁর দায় শেষ হয়েছে বলে মনে করেননি। তিনি রক্তপাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শত বিরোধিতার পরেও রাজা অবিচল ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে। এ পথেই কেবল আমরা রক্তপাত বন্ধ করতে পারি। উটপাখির মতো বালিতে মুখ লুকিয়ে নয়।

লেখক বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের প্রাক্তন ডিরেক্টর

লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Lok Sabha Election 2019 Political Violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy