চড়া রোদ্দুরে টানা আট মাস ধরে এ ভাবেই কাজ করেন অগারিয়ারা।—নিজস্ব চিত্র।
আঁজলা করে জলটা মুখে চালান করেই ফেলে দিতে হল। এত নোনতা! গা গুলিয়ে ওঠে। তখনও জানা হয়নি, এখানকার সকলের জীবনযাপনটাই নুনে পোড়া!
বিকেলের আলো নিভে আসছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই টুপ করে সন্ধে নামবে। তখনই তোলা উনুনে আগুন জ্বালালেন হংসাবেন। চড়ালেন তাওয়া। তৈরি হবে রাতের চাপাটি। সব্জিও। উনুনে জ্বলন্ত কাঠ গুঁজে হংসা বললেন, ‘‘আমরা শুধু ভোট দিই। সুবিধা কিছু পাই না। এই মরুভূমিতে এসে কে আমাদের কথা ভাববে!’’
অক্টোবরে নবরাত্রির সময় সেই যে চলে আসা মরুভূমে, বাড়ি ফেরা তো মে মাস পার করে। বর্ষা না আসা পর্যন্ত এই কচ্ছের রানেই ওঁদের সংসার। ঘর বলতে কোনও রকমে খাটিয়ে নেওয়া কয়েক বর্গ ফুটের ঝুপড়ি। তাতেই ঘেঁষাঘেঁষি করে সপরিবার থেকে যাওয়া সাত-আট মাস। ফি বছর একই রুটিন। কোনও নেতা ওঁদের কাছে আসেন না। পৌঁছয় না ভোটের কোনও বার্তাও। শুধু ভোটের দিন সকাল থেকে ছোট ছোট গাড়ি এসে ওঁদের তুলে নিয়ে যায়। ভোট ফেরতা সেই গাড়িতেই ফিরে আসা এই অস্থায়ী আস্তানায়।
তোলা উনুনে আগুন জ্বালালেন হংসাবেন।—নিজস্ব চিত্র।
সুরেন্দ্রনগর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম খারাঘোড়া। সেখান থেকে কিলোমিটার সাতেক এগোতেই ধু-ধু মরুভূমি শুরু। শেষ? গুজরাতের এই ‘লিটল রান অব কচ্ছ’ পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত। খুব ঝুরো নয়, বরং সামান্য আঁটো মাটি। না কি বালি? কয়েক কিলোমিটার ঢুকতেই ছট্টি। সেখানে একটা ছোট্ট ঝুপড়ি শৈলেশ জাখবাড়িয়াদের। কথা হচ্ছিল সেই ঝুপড়ির বাইরে বসেই। গনগনে রোদ, ৪৫ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। সামনেই লবণ তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বরফ পড়েছে। বরফের ছোট্ট টিলাও মনে হতে পারে। কিন্তু, সবটাই নুনে ভরা।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এঁরা লবণের খেত বলেন। নিজেদেরকে বলেন, অগারিয়া। কারণ, এই কচ্ছের রানে সকলে লবণের চাষ করেন। হ্যাঁ, ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যেই মরুভূমির ভিতরে চাষ। জাখবাড়িয়াদের মতো প্রায় ২ হাজার পরিবার থাকেন গোটা রান জুড়ে। সরকারি হিসেবেই প্রায় ১০ হাজার মানুষের বাস। আগে আরও মানুষ থাকতেন। তবে, ওই আট মাসের জন্যই। কিন্তু আট মাসের বাস যেখানে, সেখানে কোনও পরিষেবা থাকবে না? খাটিয়ায় বসে জাখবাড় গ্রামের প্রৌঢ় শৈলেশ বলছিলেন, ‘‘আছে তো। ২০-২৫ দিন অন্তর এখানে জল আসে বড় ট্যাঙ্কারে করে। আমরা ছোট ছোট ট্যাঙ্কে সেই জল ভরে রাখি। তবে খাওয়ার বাইরে সেই জলে কার্যত আর কিছু করা যায় না। এতই অল্প জল মেলে।’’
আরও পড়ুন: বিভ্রান্ত শিল্পনগরে দায় ঠেলাঠেলি মন্ত্রী-সাংসদের, বামেরা বইছে সিটুর ‘পাপের বোঝা’
অথচ সামনে জেনারেটরের সাহায্যে পাম্প করে অনবরত জল উঠে যাচ্ছে। টলটলে সেই জল জমা হচ্ছে মাটিতেই একটা লম্বা-চওড়া আধারে, যাকে এঁরা সল্ট প্যান বলেন। ওই জল খাওয়া বা ব্যবহার করা যায় না? প্রশ্নটা শুনে হেসে উঠলেন যশিবেন। বয়স ষাট ছাড়িয়েছে। বললেন, ‘‘এক বার মুখে দিয়ে দেখুন!’’ আঁজলায় নিয়ে মুখে দিতেই ফেলে দিতে হল। কড়া নমক! তা হলে জলের জোগান তো আরও একটু বাড়ানো যায়। শৈলেশ যেন স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘সে সব কথা কাকে বলব!’’
মনে হয় বরফের টিলা। বাষ্পীভূত হওয়ার পর লবণের কেলাস তুলে ডাঁই করা হচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র।
মালবন গ্রাম থেকে এখানে শৈলেশদের সঙ্গে আস্তানা গেঁড়েছেন অমর সিন। বোঝাচ্ছিলেন কী ভাবে লবণ চাষ করেন ওঁরা। পাম্পের সাহায্যে জল তোলা হয় নীচ থেকে। লবণাক্ত সেই জলে লবণের ঘনত্ব ১৫ থেকে ১৮ হবে। কিন্তু লবণের কেলাস (ক্রিস্টাল) তৈরি করতে সেই মাত্রা ২৪-এ নিয়ে যেতে হবে। তাই ওই জল তুলে সল্ট প্যানে জমা করা হয়। তার পর শুকাতে হয় রোদে। আসলে কড়া রোদে বাষ্পীভূত হওয়ার পর লবণের তৈরি হয় কেলাস। আর তার জন্য চড়া রোদেই করতে হয় মেহনত। অমরের কথায়, ‘‘রোদে না পুড়লে এমন সাদা-সোনা তৈরি করব কী করে! রোদ্দুরই তো আমাদের বেঁচে থাকার জান।’’ দিনে সোনা তৈরি, রাতে সে সবই ওজন করে ট্রাকে তুলে দেওয়া। নিয়ে যান ব্যাপারিরা। দিন-রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন ওঁরা।
চলছে লবণ চাষ। দেখে মনে হবে বরফ পড়েছে।—নিজস্ব চিত্র।
এ ভাবে যে ২ হাজার পরিবার থাকে, তাঁরা সরকারি কী কী সুযোগ পান? খাটিয়ায় শৈলেশের পাশে বসেই নির্মল বলছিলেন, ‘‘২০-২৫ দিন অন্তর জল আসে। গোটা লিটল রানে সর্বশিক্ষা অভিযানের অংশ হিসাবে ১৬টি টেন্ট স্কুল করা হয়েছে। প্রতিটা স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষক মাত্র এক জন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অন্তত তিনশো।’’ একটু মাথা চুলকে আবার জুড়লেন নির্মল, ‘‘ও হ্যাঁ, এই যে সোলার প্যানেলগুলো দেখছেন, বছর দুয়েক হল ওগুলো কেনা হয়েছে। সামান্য হলেও আমাদের উৎপাদন খরচ কমেছে। তাতে সরকার ৮০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে।’’ ব্যস! এটুকুই?
আরও পড়ুন: শুভেন্দুর দায়িত্বে মালদহের ভোটবাজারে ‘গৃহবন্দি’ কৃষ্ণেন্দুরা
কিন্তু নির্মলই জানাচ্ছেন, ওই সব টেন্ট স্কুলের অবস্থা বলার মতো নয়। রোদ্দুরে পুড়ে তার চাল হয়েছে শতছিন্ন। সম্প্রতি গুজরাত হাইকোর্ট স্বতপ্রণোদিত ভাবে ওই টেন্টগুলোর অবস্থা সরেজমিনে খতিয়ে দেখার নির্দেশও দিয়েছে। ‘‘আপৎকালীন কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই। ধুধু প্রান্তরে শরীর খারাপ হওয়াটা যেন অভিশাপ,’’— নির্মলের আক্ষেপ।
ঝুপড়ির পাশে জাখবাড়িয়া পরিবারের অনেকে বসে।—নিজস্ব চিত্র।
এত শত কিছু করে কষ্টের রোজগার কেমন? লক্ষ্মণ শৈলেশেরই ছেলে। বললেন, ‘‘প্রতি কেজি লবণ ২২ পয়সায় বিক্রি করি।’’ শহুরে কান ঠিক শুনল তো! ২২ পয়সা? আবার জিজ্ঞেস করা গেল। বিপুল জাখবাড়িয়ার বললেন, ‘‘হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনেছেন। এক কেজি লবণ আমরা বিক্রি করে পাই ২২ পয়সা।’’ তা হলে এত খেটেখুটে রোজগার কত? বিপুল হিসেবটা শোনালেন। গত সিজনে ওঁরা একটা পরিবার প্রায় ১৫০০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করেছেন। প্রতি মেট্রিক টন বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকায়। অর্থাৎ কিলোপ্রতি ২২ পয়সা। হ্যাঁ ঠিকই লেখা হয়েছে। ২২ পয়সা! গুণ-ভাগ করলে বছরভর বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। তার মধ্যে পাম্প করে জল তোলার জন্য জেনারেটরের ডিজেল খরচা দেড় লাখ টাকা। হাতে থাকল ১ লাখ ৮০ হাজার। ওঁরা একই পরিবারের ৯ জন এই খেতে কাজ করেন। অন্যান্য খরচখরচা বাদ দিয়ে জন প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা হাতে পান। শহুরে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য! বাজারে প্যাকেটজাত লবণের মূল্য তো অনেক বেশি। বাকিটা কোথায় যায়? শৈলেশের কথায়: ‘‘সে আমরা কী করে জানব বলুন তো! ওই ব্যাপারিরা বলতে পারবে।’’
এত যে কষ্ট, সে সব জানেন জনপ্রতিনিধিরা? খারাঘোড়া গ্রামেই থাকেন অম্বু পটেল। ভিন রাজ্য থেকে ভোট দেখতে যাওয়া সাংবাদিককে তিনি বলছিলেন, ‘‘এই লবণ চাষিদের জন্য কোনও সরকারই তেমন করে ভাবেনি। যা যা ভাবা হয়েছে, তার গোটাটাই সাময়িক।’’ কেন? অম্বুর কথায়, ‘‘কচ্ছ এলাকায় লবণের এই চাষ তো বেআইনি। তাই কেউ গুরুত্ব দেয় না হয়তো।’’ তিনিই জানালেন, এই মরুভূমিকে ‘ওয়াইল্ড অ্যাস স্যাংচুয়ারি’ ঘোষণা করা হয়েছে। ওয়াইল্ড অ্যাস অর্থাৎ ক্ষুর। যে জন্তুর উল্লেখ পাওয়া যায় মুঘল সম্রাট আকবর আর জাহাঙ্গিরের শিকার কাহিনিতে। তবে গোটা দেশে যে লবণ রফতানি হয় তার ৮০ শতাংশই আসে এই কচ্ছের রান থেকে, সেটাও মনে করিয়ে দিলেন অম্বুভাই।
শৈলেশকে জিজ্ঞেস করা গেল, ভোট দেবেন তো আপনারা? পড়ন্ত সন্ধ্যায় জবাব এল, ‘‘হ্যাঁ দেব। নিতে এলে যাব। না হলে রোদ্দুরের মধ্যে হেঁটে হেঁটে তো আর যেতে পারব না! আর ক’বারই বা দিতে পারব। এটাই হয়তো শেষ ভোট।’’ বাকিটা জুড়ে দিলেন শৈলেশের স্ত্রী যশিবেন, ‘‘আসলে এই কাজ করে তো বেশি দিন বাঁচি না আমরা। আমাদের পরিবারের কেউই ষাট পেরোয়নি।’’
তার মধ্যেই চাপাটি-সব্জি খেতে যাওয়ার ডাক আসে শৈলেশদের। খাটিয়াতেই চলে আসে ছোট ছোট স্টিলের থালা। রাতের খাবার। সূর্য ডুবে চাঁদ এসে গিয়েছে রানের আকাশে। তাতেও তাপ কমে কই! ফিরতি পথে একটু এগিয়ে দিলেন শৈলেশ। কথায় কথায় বললেন, ‘‘যাঁদের ভোট দিয়েছি, তাঁদের কত বার বলতে চেয়েছি, লবণের দাম বাজারে এত বেশি, আমরা কেন কম পাই? কিন্তু, আজ অবধি তাঁদের দেখাই পেলাম না! জীবনের তো সবটাই কেটে গেল এই মরুভূমিতে।’’
প্রচার নেই। ফেস্টুন-ব্যানার নেই। নেই প্রার্থীদের আসা-যাওয়া। তবু ভোট আসে ওঁদের জীবনে। চেনা দুঃখ-চেনা সুখ-চেনা চেনা নোনা জীবন!
গণতন্ত্র কড়া নাড়ছে মরুতীর্থে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy