E-Paper

রক্তে ফুটবলের নেশা রুখে দিয়েছে বাল্যবিবাহ

চা বাগানের সবুজকে দু’পাশে রেখে সরু রাস্তাটা পৌঁছে গেল জীর্ণ একটি স্কুলবাড়ির কাছে। সামনেই বিরাট মাঠ। আজ সেখানে যেন উৎসবের পরিবেশ। উৎসব ফুটবলের।

অঞ্জন সাহা

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৫
ফুটবল মাঠে মেয়েরা।

ফুটবল মাঠে মেয়েরা। —নিজস্ব চিত্র।

ত্রিপুরার কৈলা শহর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে পাশে রেখে আঁকাবাঁকা পথ চলেছে বুধা উড়াং বস্তির দিকে। কিছু ক্ষণ এগোলেই দু’পাশে চোখ জুড়োনো চায়ের বাগান। ভোরে আদিগন্ত চায়ের বাগানে সোনালি আলো, পাতা তোলার পরিচিত দৃশ্য। বাগানের ধার দিয়ে পিচ রাস্তার পাশে চোখে পড়ে শ্রমিকদের ছোট বসতি, দোকানপাট।

চা বাগানের সবুজকে দু’পাশে রেখে সরু রাস্তাটা পৌঁছে গেল জীর্ণ একটি স্কুলবাড়ির কাছে। সামনেই বিরাট মাঠ। আজ সেখানে যেন উৎসবের পরিবেশ। উৎসব ফুটবলের। সাতসকালেই মাঠের পাশে ভিড় করেছে মেয়ের দল। এমন প্রত্যন্ত এলাকায় ছয়, সাত, দশ, পনেরো, কুড়ি বছর বয়সি একশোরও বেশি বালিকা, কিশোরী, সদ্যযুবতী ফুটবলারের জটলা দেখে চমক লাগে। গায়ে নীল বা সবুজ জার্সি, হাফপ্যান্ট। অধিকাংশের পায়ে বুট। আবার ধুলো মাখা সস্তা চটি পরেও দাঁড়িয়ে অনেকে। আজ বাকিরাও পাবে খেলার বুট। সেই উৎসাহে অপেক্ষায় মেয়েরা।

মৌসুমী, প্রবাসিনী, সাথী, বিসাতির মতো একশোরও বেশি মেয়ে আশপাশের বারোটি চা বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলি থেকে এসেছে। কয়েক বছর ধরে তাদের রক্তে ফুটবলের উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে এলাকারই ফুলো ঝানো অ্যাথলেটিক ক্লাব। স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই মহিলা সৈনিকের স্মৃতিবিজড়িত ক্লাবটি এখন হতদরিদ্র মেয়েদের নিয়ে ফুটবলের সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের নামী ফুটবল ক্লাবগুলির মতো বৈভব নেই। তবে নামগোত্রহীন ছোট্ট ক্লাবটি ফুটবলকে সামনে রেখে গোটা এলাকায় যেন সামাজিক পরিবর্তনের বার্তা দিয়ে চলেছে।

ছোট ছোট মেয়েদের হাতে বুট তুলে দিয়ে ক্লাবের সভাপতি জয়দীপ রায় বললেন, “এই বুট দিয়ে ফুটবলে যখন লাথি মারবি, মনে করবি, আরও অনেক কিছুতে লাথি মারছিস!” চকচক করে ওঠে মেয়েদের চোখ। জয়দীপ জানালেন, এই মেয়েদের সামনে বিপদ দু’টো। প্রথমত, খুব কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকে পরিবারের। না হলে বিভিন্ন শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পরিচারিকার কাজে। ফুটবল-ঝড় এই দু’টো চ্যালেঞ্জকেই অনেকটা আটকে দিয়েছে। কারণ, খেলাকে সামনে রেখে একজোট হয়ে গিয়েছে মেয়েরা। তাদের মনে জন্ম নিয়েছে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের প্রতি আত্মবিশ্বাস।

শুরুটা অবশ্য অন্য রকম ছিল। চার বছর আগে এলাকারই মেয়ে মৌসুমী উড়াং জাতীয় স্তরে অনূর্ধ্ব সতেরোয় ফুটবল খেলার সুযোগ পায়। তাকে সংবর্ধনা দেয় ত্রিপুরা চা শ্রমিক উন্নয়ন সমিতি। তখনই এলাকার মেয়েরা জানায়, তারাও ফুটবল খেলতে আগ্রহী। সেই স্বপ্ন নিয়েই শুরু ফুলো ঝানো ক্লাব। একেবারে কপর্দকহীন অবস্থা। অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বৈকুণ্ঠনাথ তর্কভূষণ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। কয়েক দফায় জার্সি, বুট, খেলার উপকরণ দেয় তারা। খেলতে এগিয়ে আসে অসংখ্য মেয়ে। মনু ভ্যালি, গোলকপুর, তাচাই বাগান, রাংরুংয়ের চারটি মাঠে আলাদা আলাদা ভাবে টিম গড়ে খেলা শুরু। আর আজ ক্লাবের ছাতার নীচে জড়ো হয়েছে প্রায় সত্তরটি শ্রমিক পরিবারের ১২০ জন মেয়ে ফুটবলার।

ট্রাস্টের সভাপতি প্রণব রায়ের কথায়, “খেলার উপকরণ দিলেই সমস্যা শেষ হয় না। দরিদ্র পরিবারগুলির এতগুলি মেয়ের পুষ্টির অভাব মেটানোটা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়েছে। তবে বছরভর চালানো সম্ভব হচ্ছে না।’’ শুরু থেকে ক্লাবের পাশে থেকেছে ত্রিপুরা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
কোচ নিয়োগ করেছে তারা। খেলার সরঞ্জাম দিয়েছে। তবে এই বিষয়ে কৈলা শহরের প্রাক্তন জেলাশাসক বিশাল কুমারের সহযোগিতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন ক্লাবকর্তা বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত। বিশাল বর্তমানে বদলি হয়ে ত্রিপুরা পশ্চিমের জেলাশাসক। আগরতলার বাসভবনে বসে তরুণ জেলাশাসক বললেন, ‘‘বিষয়টাকে শুধুমাত্র খেলা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর পিছনে সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেই স্বপ্নটা কিছুতেই মরতে দেওয়া যাবে না।’’

ত্রিপুরার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় একশো ‘কোনি’কে গড়ে তোলার এমন প্রয়াস ভারতের নামজাদা ক্লাবগুলির কাছেও শিক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

football Kerala

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy