Advertisement
E-Paper

রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লিখেও রাষ্ট্রের অংশ হন মহাশ্বেতা

প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় যাঁরা হৃদয়ে অনুভব করে অনেক না পাওয়ার বা প্রান্তিক হওয়ার তেতো স্বাদ, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে যাঁরা বোঝেন না এই প্রান্তিকতা আসলে স্বাভাবিকতা-প্রসূত নয়, বরং এই প্রান্তিক অস্তিত্ববোধের পিছনে রয়েছে সচেতন ভাবে প্রান্তিকায়িত করে রাখার এক নিরন্তর কূট-কৌশল, তখন এই প্রান্তিকায়িত সত্ত্বারা খুঁজে ফেরে সম-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষদের।

শান্তনু সরকার

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৯

প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় যাঁরা হৃদয়ে অনুভব করে অনেক না পাওয়ার বা প্রান্তিক হওয়ার তেতো স্বাদ, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে যাঁরা বোঝেন না এই প্রান্তিকতা আসলে স্বাভাবিকতা-প্রসূত নয়, বরং এই প্রান্তিক অস্তিত্ববোধের পিছনে রয়েছে সচেতন ভাবে প্রান্তিকায়িত করে রাখার এক নিরন্তর কূট-কৌশল, তখন এই প্রান্তিকায়িত সত্ত্বারা খুঁজে ফেরে সম-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষদের। খুঁজে পেলে মননের দিক থেকে অন্তত তাঁরা একে অপরের সঙ্গে এক ধরনের সামূহিকতা অনুভব করে, মরমী হয় একে অপরের

জন্য। আর সেই না পাওয়া, প্রান্তিকায়িত, অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া মানুষদের কথা যদি কেউ উপস্থাপন করে আলোকবৃত্তে পৌঁছন, তখন তো তিনি এই মানুষদের কাছে বড় আদরের হয়ে ওঠেন।

মহাশ্বেতাদেবী স্মরণে গত সপ্তাহে শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ‘আমাদের সমকাল’-এর সংগঠকরা। সেখানে এই অঞ্চলের নানা বয়সী পাঠক-পাঠিকার কথায় একদিকে যেমন মহাশ্বেতার জন্য
এই আদরের বোধ উঠে এল, তেমনি এল পরম আত্মীয়কে হারানোর দুঃখঘন অনুভূতিও।

ঝাঁসির রানিকে নিয়ে জীবনী লিখতে গিয়ে তিনি যে নতুন ধরনের ইতিহাস নির্মাণে ব্রতী হলেন, সেই অভিজ্ঞতার স্বাভাবিক পরিণতি ‘হাজার চুরাশির মা’। ‘সুজাতা’ ‘দ্রৌপদী’রা যে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুই ভিন্নমাত্রার দরদী প্রতিবাদ, তা-ও উঠে এল শহর শিলচরের বক্তাদের কথায়। চা বাগান থেকে আসা সাহিত্যিক-শিক্ষিকা কাজল দেমতার বয়ানে উঠল তাঁদের মহাশ্বেতার কথা। যেখানে অরণ্যের অধিকারের অংশবিশেষ নাট্যরূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল চা বাগানে। মহাশ্বেতা সম্পাদিত ‘বর্তিকা’ পত্রিকার এক রকম প্রেরণাতে কাজলও চা বাগানে এমন পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে সমাজের খেটে খাওয়া অংশের তথাকথিত অ-লেখকদের লেখা ছাপা হয়। ‘বর্তিকা’-তে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা ছাপানোর প্রসঙ্গে কিছু অভিজ্ঞতা শোনা গেল অমিত শিকিদারের বক্তব্যে। তার সঙ্গেই একটা বেশ আকর্ষক তথ্যও পাওয়া গেল যে, ‘হাজার চুরাশির মা’ প্রকাশের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সেটি পড়ে রেডিওর জন্য একটি নাট্যরূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন যা নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি।

এই অঞ্চলে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় এবং বিশেষ করে তার বাংলা সাহিত্য বিভাগের পাঠক্রম অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনুকরণযোগ্য হয়েছে যে কারণে, তার অন্যতম দিক হল পাঠ্যক্রমে প্রায় সমসাময়িক লেখাগুলির অন্তর্ভুক্তি। অন্তত এই কারণে এই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা এক ভাবে মহাশ্বেতাদেবীর লেখার সাথে পরিচিত। ছাত্রী কাবেরী প্রয়াত মহাশ্বেতাদেবীর গল্পে আধিপত্যের প্রসঙ্গ যেমন উল্লেখ করলেন, তেমনই মহাশ্বেতার জীবনের সেই সংবেদনশীল অংশ যা পারতপক্ষে তাঁর গুণমুগ্ধরাও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, অর্থাৎ নিজ সন্তানকে
ছোট থাকতেই ছেড়ে আসা, সেই ঘটনাকে একধরনের সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করলেন। এতে তাঁকে কিছুটা বিরোধের সামনেও পড়তে হয়। এক জন তো একে মহাশ্বেতা-জীবনের অন্ধকার অধ্যায়, হিসেবেই আখ্যায়িত করলেন।

মহাশ্বেতাদেবীর শেষ জীবনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অবশ্য বিতর্কের পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তিনি কি রাজনৈতিকভাবে বিচ্যুত হলেন, নাকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো বামপন্থার নামে বামপন্থার বিরোধিতা করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন— তাই ছিল বিতর্কের মূলকথা। আলোচনায় এক জনের বয়ানে জানা গেল, আসাম আন্দোলনের সময়ে তাঁরা কোনও কারণে মহাশ্বেতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁর আলফাকে সমর্থনের দৃঢ় অবস্থানের অভিজ্ঞতাটিও।

লেখক তাঁর লেখায় যাঁদের কথা তুলে আনেন, তাঁরা তাঁর লেখা পড়বেন এমনটা সব সময় হয়ও না, বা লেখকের আশাও থাকে না। কিন্তু তাঁর অর্থ এই নয় যে লেখক তাঁদের জন্য লেখেন না। সাহিত্য পড়েন তো মূলত সমাজের একটা অংশেরই মানুষ, কিন্তু তাঁরাই সমাজের নীতি নির্ধারক বা নানা ভাবে সামাজিক নীতিকে প্রভাবিত করেন। সে কারণে সাহিত্য পাঠের মধ্যে দিয়ে তাঁদের কী অবস্থান গড়ে উঠছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য অঞ্চলের মতোই বরাক উপত্যকাতেও সেই ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মানুষরা মহাশ্বেতাদেবীকে একই সঙ্গে আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক ও সাহিত্যিক হিসেবে মূল্যায়ন করেন। ‘লেখাকর্মী’ শব্দবন্ধ যে তাঁর জন্যেই যথার্থ ভাবে প্রযোজ্য, এটা যেমন ওই দিনের একটা অনুভূতি, তেমনই এক ভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লিখেও তিনি কী ভাবে রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যান এ বিষয়ও কোনও কোনও পাঠকের বয়ানে পাওয়া যায়। তবে তাঁর লেখালেখি বা কাজকর্মের যে বহুমাত্রিকতা, তার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ই উঠে এসেছিল সে দিনের পাঠকদের মতামতে। ছোটদের লেখা বা অন্যান্য বিষয় অনালোচিতই থেকে গিয়েছে হয়তো সময়ের কারণে।

(লেখক আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক)

Mahasweta Devi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy