সোমবার বোলপুর পৌঁছলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ, মঙ্গলবার প্রশাসনিক বৈঠক করবেন তিনি। —নিজস্ব চিত্র।
কিছু দিন যাবৎ বিজেপি-র বিরুদ্ধে চ়ড়া সুর শোনা যাচ্ছিল না তাঁর গলায়। সেই নীরবতা ভেঙে সোমবার মধ্যপ্রদেশের ব্যপম-কাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি-র সবর্ভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় পা দেওয়ার ঠিক আগের দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের কোনও কর্মরত বিচারপতিকে দিয়ে ব্যপম কেলেঙ্কারির তদন্তের দাবি করেছেন। সংসদেও এই নিয়ে তাঁর দল হইচই করবে বলে জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
প্রশাসনিক বৈঠকের জন্য বীরভূম যাওয়ার আগে সোমবার নবান্নে মমতা বলেন, ‘‘আমি ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। এটা নিছক কোনও আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়। এটা খুব বড় ঘটনা। এর পিছনে বড় কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে! পিছনে কে আছে, তা বের করতে হবে।’’ ব্যপম-কাণ্ডকে ‘ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই ধরনের ঘটনা হওয়া উচিত নয়। সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সত্যি ঘটনা কী, তা আমরা জানতে চাই।’’ এই ঘটনার পিছনে বড় কোনও শক্তি রয়েছে বলেও মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী।
সম্প্রতি ললিত মোদী বিতর্কে সুষমা স্বরাজের নাম জড়ানোয় তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায় বিদেশমন্ত্রীর ইস্তফার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু তখন মমতাই দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনকে দিয়ে বিবৃতি জারি করে কড়া বিজেপি-বিরোধিতার পথ থেকে সরে এসে এক ধরনের ‘নিরপেক্ষ অবস্থান’ নিয়েছিলেন। সুষমা-বসুন্ধরা বিতর্ক থেকে শুরু করে কেন্দ্রের মন্ত্রীদের বিমান-পর্ব, তার পরে মধ্যপ্রদেশের ব্যপম-কাণ্ডের সঙ্গে এক সাংবাদিকের মৃত্যুর ঘটনা জড়িয়ে যাওয়া— এই পর্যন্ত সরাসরি মমতা মুখ খোলেননি। ডেরেকের মতো দলের মুখপাত্রেরা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বটে কিন্তু তৃণমূল নেত্রী নিজে সরব হননি। স্বভাবতই রাজনৈতিক শিবিরে প্রশ্ন উঠছে, কেন মমতা এখন ব্যপম-কাণ্ডে মুখ খুলতে গেলেন?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সুষমা-বসুন্ধরা থেকে শুরু করে সব বিতর্কেই বিজেপি-র বিরুদ্ধে কংগ্রেসের পাশাপাশি বামেরা বিরোধী দলের পরিসরটি এখন থেকেই দখল করতে শুরু করেছে। গত অধিবেশনেও তৃণমূল যে বিরোধী পরিসর দখল করে নিয়েছিল, সেখান থেকে অনেকটাই বিচ্যুতি হতে শুরু করেছে তাদের। মমতা আজ নিজে মুখ খুলে সেই পরিসরটিই ফের দখল করতে চাইলেন। ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন, সংসদেও তাঁরা এই নিয়ে সরব হবেন।
তার চেয়েও বড় কথা, নানা বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতার বার্তা অনেক দিন ধরেই ছড়িয়ে পড়েছে। তা সে বাংলাদেশ সফর হোক বা সম্প্রতি সুষমা-বিতর্কের সময় সৌগতের বিরোধিতাকে দলনেত্রীর খণ্ডন করাই হোক। এমতাবস্থায় তৃণমূল যাতে বিজেপি-র ‘বি-টিম’ হিসেবে প্রতিপন্ন না হয়, তার জন্যও সচেষ্ট হতে হয়েছে মমতাকে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘ঘনিষ্ঠতা’র খেসারত দিতে হচ্ছে বিজেপিকেও। সে কারণে অমিত মধ্যপ্রদেশেরই নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের মতো দলের সাধারণ সম্পাদককে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিয়ে নতুন কলেবরে জমি দখলের লড়াইয়ে নামতে চাইছেন। মমতা জানেন, বেশ কিছু দিন পরে কলকাতায় গিয়ে অমিত যখন কর্মিসভায় যোগ দেবেন, তখন তাঁর পক্ষে দলের সভাপতি হিসাবে তৃণমূল-প্রশস্তিতে মজে থাকা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় মমতা আগেভাগেই বিজেপি-র
বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে রাখলেন। যাতে এর পরে অমিত যা-ই বলুন না কেন, সেটি তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই
গণ্য হয়!
তবে বিজেপি-র নেতারা বলছেন, মমতা তাঁদের আক্রমণও করেছেন সুকৌশলে। এত দিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে চলতে থাকা নানা বিতর্কে চুপ থেকেছেন। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের এমন একটি বিষয়ে সরব হয়েছেন, যেটা সরাসরি মোদীর বিরুদ্ধে নয়। এমনকী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মোদীর সেনাপতি অরুণ জেটলিও ঠারেঠোরে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বিপক্ষেই মন্তব্য করেছেন। বিজেপি-র অন্দরেও এই নিয়ে গোলমাল রয়েছে। আবার মমতা আজ সরাসরি সিবিআইয়ের দাবিও তোলেননি। কারণ, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে তিনি নিজেই মুখর। তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাই বলছেন, নন্দীগ্রাম, নেতাই, নোবেল চুরির মতো ঘটনার তদন্তে নেমে কোনও ক্ষেত্রেই কিছু করতে পারেনি সিবিআই। তাই সিবিআই তদন্তে তাঁদের ভরসা নেই। সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত করালেই বরং সত্য বেরিয়ে আসবে। এর জেরে এখন বিজেপি নেতারাই বলছেন, নিছক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলেন মমতা! আজ দুপুরে মমতার প্রতিক্রিয়ার পরেই অমিত দিল্লিতে দলের সদর দফতরে পশ্চিমবঙ্গের নতুন ভারপ্রাপ্ত নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ
করেন। কাল তিনি কী বলেন, এখন তারই অপেক্ষা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy