শরদ পওয়ারের বাড়িতে সেই বৈঠক। ছবি: পিটিআই
নরেন্দ্র মোদীর ২৮২টি আসনের শক্তপোক্ত বিজেপি সরকার গঠনের এক বছর যেতে না যেতেই দুর্নীতির প্রশ্নে আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষ। তিন সপ্তাহের বাদল অধিবেশন কার্যত মাঠে মারা গিয়েছে। সংসদের অচলাবস্থার পাশাপাশি বিহারে লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমার ও কংগ্রেস সে রাজ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই জোট ঘোষণা করে দিয়েছে।
ঠিক এ রকম এক মোহভঙ্গের পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আড়াই দিনের দিল্লি সফরে ইট পেতে রেখে দিয়ে গেলেন বিহার ভোট-পরবর্তী সবর্ভারতীয় রাজনীতির পাশা খেলার নির্ধারক শক্তি হওয়ার অভিমুখে। সিপিএম-সহ বাম দলগুলির যখন পঞ্চাশের উপরে সাংসদ ছিল, তখন জাতীয় রাজনীতির অনিশ্চয়তার সময়ে বাম গোষ্ঠী একটি নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করত। আজ সেই সিপিএমের দুর্জয় ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিপিএমের সাংসদ মাত্র দু’জন। লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে সিপিএম তথা বাম দলগুলির মোট সাংসদ সংখ্যা যথাক্রমে ১৮ ও ২০। সেখানে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা দু’কক্ষ মিলিয়ে ৪৬। সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যাই ব্রহ্ম— এই মন্তব্য তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আড়াই দিনে এই সংখ্যার দাপট এ বার দেখালেন মমতা।
মমতা কী করেছেন?
প্রথমত, শরদ পওয়ারের বাড়িতে গিয়ে ফারুক আবদুল্লা, মুলায়ম সিংহকে সঙ্গে নিয়ে ফেডারেল ফ্রন্টের সম্ভাবনা নিয়ে বৈঠক করেছেন। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস তথা বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেন। সনিয়া ও রাহুলের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎকার হয় তাঁর। তৃতীয়ত, অমিত শাহ রাজ্যে তৃণমূলকে আক্রমণ করলেও, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী ‘সহাস্য’ বৈঠক। তিনটি পাখিই মারতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক) সর্বভারতীয় পরিস্থিতিতে শক্তিশালী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারকে দুর্বল করার দাবি সহজাত। বলা যায়, প্রকৃতির সূত্র। তাই লালুপ্রসাদ-নীতীশ যতই ঝগড়া থাক, তাঁরা জোট বাঁধতে বাধ্য হয়েছেন। মমতাও বুঝতে পারছেন, ফেডারেল ফ্রন্ট গঠনের প্রয়াস মোদী সরকারকে চাপে রাখতে বাধ্য। যে মোদী সরকার এ বছরের শুরুতে সিবিআইকে অস্ত্র করে মমতাকে বিপাকে ফেলতে চেয়েছিল, এখন তারাই সংসদের ভিতরে-বাইরে নানা ভাবে ব্যতিব্যস্ত। কাজেই এই সময়টা মমতার জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ।
দুই) বিজেপি-কে চাপে রাখার পাশাপাশি মমতা বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে নিজের রাজনৈতিক জমিটিকে বিহার নির্বাচনের আগেই তৈরি করে নিতে চাইছেন। অতীতে সিপিএম যে কাজটি করত, এ বারে মমতা সেই কাজটি করতে চাইছেন। এক সময়ে জ্যোতি বসু এবং হরকিষেণ সিংহ সুরজিতকে সর্বভারতীয় রাজনীতির ভাঙা-গড়ার খেলায় সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। এ বার সেই কাজে দেখা গেল মমতাকে। তৃণমূল নেত্রী মনে করছেন, বিহারে বিজেপি-র বিপদ আসন্ন। নীতীশ কুমারও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন মমতার সঙ্গে। মুলায়ম, এমনকী অখিলেশের সঙ্গে মমতার যথেষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। এ বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের সঙ্গেও মমতা যোগাযোগটা করে ফেললেন।
তিন নম্বর পাখিটিকে তিনি মেরেছেন বিজেপি-বিরোধী ফ্রন্টে প্রয়োজনে কংগ্রসকে সঙ্গে রাখার কথা বলে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যস্তরে কংগ্রেস-সিপিএমের আঁতাতের চেষ্টাতেও জল ঢেলেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি হওয়ায়, কংগ্রেস-সিপিএম বোঝাপড়া বাড়বে বলে অনেকে মনে করলেও, সংসদের সংখ্যায় বামেদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে কিন্তু তৃণমূল। তাই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সনিয়া গাঁধীর কাছে সিপিএমের চেয়ে মমতাকে অনেক বেশি প্রয়োজন।
আসলে আড়াই দিনে রাজনীতির ক্ষেত্রভূমিতে এসে পরিস্থিতিটি যাচাই করে গেলেন মমতা। পাঁচ মাস পরে এসেছিলেন। আবার আসবেন ২২ সেপ্টেম্বর, বিহার ভোটের মুখে। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘‘১৯৮৪ সালে মমতা কিন্তু সংসদ থেকেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটটি তাই তিনি ভাল বোঝেন।’’ মমতার নিজের ভাষায়, ‘‘রাজনীতি হল নতুন সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করা। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি জোট গঠনে আগ্রহী তৃণমূল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy