কানে ভাল শুনতে পাচ্ছি না, নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তাররা বলছেন, দু’পায়েরই হাড় ভেঙেছে। কিন্তু এই ঘটনার পরেও যে বেঁচে আছি, সেটাই তো বড় কথা।
ঘোরের মধ্যেই অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে হাসপাতালে আসার পথে দেখে এসেছি, আমার বন্ধুর নিথর দেহ। ডাক্তারি পড়ুয়া হিসেবে মৃতদেহ দেখার অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু কাউকে হাতে খাবারের থালা ধরে বসে থাকা অবস্থাতেই ওই ভাবে ঝলসে যেতে কখনও দেখিনি। গায়ের মাংস কালো হয়ে খসে খসে পড়ছে! থালা ধরা হাতের হাড়গুলোও যেন টোকা লাগলেই ভেঙে যাবে!
জামনগর থেকে যাতায়াত করা কঠিন। তাই আমদাবাদ বি জে মেডিক্যাল কলেজের (আমদাবাদ সিটি হাসপাতাল) ডাক্তারি পড়ুয়াদের মেসেই থাকছি। সেই মেসের উপরেই যে এ ভাবে বিমান ভেঙে পড়তে পারে, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে জরুরি কাজে বেরোনোর ছিল বলে সকালে মেসেই ছিলাম। দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে বসে খাওয়া সেরেছি। এর পর নিজের ঘরেই ছিলাম। অন্য এক ডাক্তারি পড়ুয়া বন্ধু ফোন করে ডাকল। মেস থেকে তখন বার হতে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনতে পাই, পিছন থেকে একটা বিকট আওয়াজ যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘাড় ঘোরাতে না ঘোরাতেই দেখি একটা বিশাল বিমান আমাদের মেসের একটি অংশে এসে আছড়ে পড়ল।
এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এমন এক ধুলোর ঝড় এল, যা আমায় উড়িয়ে নিয়ে দূরে ছিটকে ফেলে দিল। কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। নড়াচড়া করারও অবস্থা ছিল না। তত ক্ষণে কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে আশপাশের সব কিছু। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এর পর আর কিছু মনে নেই। বহু ক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরতে বুঝতে পারি, আমায় কয়েক জন ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গোটা শরীরে ব্যথা। তার মধ্যেই দেখলাম, বিমানের ভাঙা অংশ এ-দিক ও-দিক জ্বলন্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গোটা এলাকা যেন গরমে ফুটছে। চারপাশের সব কিছু কেমন যেন কালো হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই দেখলাম, পরপর অনেকগুলি মানুষ মাটিতে পড়ে রয়েছে। সেখানেই চোখে পড়ল, হাতে থালা ধরে বসে রয়েছে আমার বন্ধু। তার গোটা শরীর কালো হয়ে গিয়েছে। একই অবস্থা আশপাশের বহু দেহেরই। যেন, যে যেমন ছিল, সেই অবস্থাতেই কালো পাথর হয়ে গিয়েছে। দেখলাম, এক জনকে চাদরে মুড়ে তোলার চেষ্টা করছেন কয়েক জন। তাঁর হাড় ভেঙে যাচ্ছে, গা থেকে সমস্ত কিছু খসে খসে পড়ছে। এর পর আবার অজ্ঞান হয়ে যাই।
হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতে বুঝতে পারি, পা নাড়ানো যাচ্ছে না। জানতে পারি, প্রথমে একটা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে, পরে চারতলার অন্য ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতেই আমার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।
কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সে সব শুনছিলাম চিকিৎসকদের কাছে। শুনতে শুনতে শিউরে উঠেছি, মেসের ভিতরে তো ঘটনার সময় শ’খানেক মানুষ ছিল। তার মানে কি বেশিরভাগই এই দুর্ঘটনার বলি হয়েছেন? যে ডাক্তারই দেখতে আসছেন, তাঁর কাছে খোঁজ নিচ্ছি, আমার মতো বেঁচেছেন ক’জন? কিন্তু কারও থেকেই কোনও স্পষ্ট জবাব পাইনি। আমারই এক বন্ধু আমার পাশের শয্যায় ভর্তি। সে আবার ভেবেছে, ছাদ থেকে কোনও কারণে চাঙড় ভেঙে পড়ছে। এত আওয়াজ কী করে সে শুনতে পেল না, তা-ই ভাবছি।
আমার পরিবারের লোকজন হাসপাতালে চলে এসেছেন। আমি যে বেঁচে আছি, এটা যেন তাঁরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দেখার পরে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। একই ভাবে শুক্রবার আশ্বস্ত করে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেমন আছি, এসে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁকে জানিয়েছি, যা করতে হয় করুন, আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)