রামচন্দ্র ছত্রপতি।
গুলি করে হত্যা করেও থামানো যায়নি তাঁকে। তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসা একের পর এক সত্য-বাণ ‘পর্দা ফাঁস’ করেই প্রভাবশালী ‘হজুর বাবা’ গুরমিত রাম রহিম সিংহকে পৌঁছে দিল কারাগারে।
সবর্ভারতীয় একটি হিন্দি দৈনিকের হরিয়ানার সিরসা এলাকার সংবাদদাতা ছিলেন রামচন্দ্র ছত্রপতি। সাদামাঠা কিসান পরিবারের ছেলে। আইনের স্নাতক হয়ে ওকালতি শুরু করলেও মন ভরেনি। হাতে তুলে নেন কলম। সর্বভারতীয় দৈনিকে কাজ করেও রামচন্দ্রের মনে হয়, এলাকার খবর করতে হলে স্থানীয় কাগজই দরকার। সেই জেদ থেকেই ২০০০ সালে প্রকাশ করেন ‘পুরা সচ্’ নামের একটি পত্রিকা। তাতেই একের পর এক ‘পর্দা ফাঁস’ শুরু করেন ‘ডেরা সচ্চা সৌদা’র ‘হজুর বাবা’র। ‘ডেরা সচ্চা সৌদা’র অর্থ— আসল সত্যের কেন্দ্র (প্লেস অব রিয়েল ট্রুথ)। আর রামচন্দ্রের কাগজের নামও ‘পুরা সচ্’। কী আশ্চর্য সমাপতন!
সেই সত্যের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রামচন্দ্রের ছেলে অংশুল-ও। তিনিও সাংবাদিক। শুক্রবার ফোনে আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘বাবার বলিদান সার্থক হল। তবে তাঁর খুনিরা যে-দিন শাস্তি পাবে, সে-দিন আমরা শান্তি পাব।’’ এই ঘটনার পরে তাঁর বা তাঁর পরিবারের উপরে হামলার আশঙ্কা করছেন কি? অংশুলের জবাব, ‘‘বাবা ওদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন। মানুষ ওদের চিনে গিয়েছে। আর ওদের কোনও ক্ষমতা নেই।’’
২০০২-এ রামচন্দ্রের ‘পুরা সচ্’-এ লেখা বেরোয় গুরমিতের আশ্রমে নির্যাতিতা এক সাধ্বীর। নাম প্রকাশ না-করে তিনি জানান, কী ভাবে তাঁর উপরে অত্যাচার ও ধর্ষণ চালিয়েছে গুরমিত। নাম প্রকাশ না-করে সেই সাধ্বীর চিঠি যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে। প্রতিলিপি পাঠানো হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং রাষ্ট্রপতির কাছেও। শুরু হয় সিবিআই তদন্ত। অন্তর্তদন্তমূলক খবর প্রকাশ করতে থাকেন রামচন্দ্র। ‘পুরা সচ্’-এর সেই সব খবর তখন ফোটোকপি করে বিলি হতো হরিয়ানার বিভিন্ন প্রান্তে।
শুরু হয় পাল্টা চাপ। রামচন্দ্র আঘাত করেছেন কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাসে, এই অভিযোগ তুলে খুনের হুমকি আসতে থাকে লাগাতার। খোঁজ শুরু হয় ‘ডেরা সচ্চা সৌদা’য় রামচন্দ্রের ‘সোর্স’-এরও। কে তাদের ‘হজুর বাবা’র কেচ্ছার খবর নিখুঁত ভাবে পৌঁছে দিচ্ছে রামচন্দ্রের কাছে?
রাম রহিমের আশ্রমে দশ প্রধানের এক জন ছিলেন রঞ্জিত। তাঁর বোন ছিলেন সেখানকার সাধ্বী। চেলাদের সন্দেহ হয়, ওই দু’জনই রামচন্দ্রকে খবর দিচ্ছেন। আশ্রম ছেড়ে পালান ভাইবোন। রক্ষা পাননি। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দেন রঞ্জিত। পুলিশের কাছে নিরাপত্তার আবেদন জানান রামচন্দ্র। কিন্তু দু’রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে সর্বোচ্চ স্তরের আমলারা যে-‘বাবা’র পায়ে মাথা ঠেকান, তাঁর বিরুদ্ধে যাবেন কে? ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর রামচন্দ্র গুলিবিদ্ধ হন। ২৮ দিন দিল্লির হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে হার মানেন ওই সাংবাদিক। রাস্তায় নামেন হরিয়ানার নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ।
হরিয়ানার এক প্রবীণ সাংবাদিক ফোনে বললেন, ‘‘আমাদের এখানে বাংলার মতো কথায় কথায় প্রতিবাদ-আন্দোলনের চল নেই। তবে রামচন্দ্র খুনের পরে শহর জেগে উঠেছিল। গ্রামের মানুষও শহরে এসে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। হাজার হাজার সই সংগ্রহ হয়েছিল।’’ তার জেরেই আদালত ওই দুই খুনের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত রাম রহিম। সেই মামলা এখনও চলছে।
রামচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘সচ্ অউর ঝুট কা বিচ কোই তিসরি চিজ নেহি হোতি। অউর ম্যায় সচকে সাথ খাড়া হুঁ’ (সত্য আর মিথ্যার মাঝখানে তৃতীয় কিছু থাকতে পারে না। আর আমি সত্যের সঙ্গেই রয়েছি)।
পূর্ণ সত্যের অঙ্গীকার ছিল তাঁর কাগজের নামে। প্রাণ দিয়ে সত্যরক্ষাই করে গেলেন এ-কালের রামচন্দ্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy