কলকাতার ঝকঝকে রাজপথে উন্মুখ কিন্তু শৃঙ্খলিত জনতার সেই ছবি আজও দেখা যায় কোনও কোনও সাবেক ব্রিটিশ মুভিরিলে। বিলেতের রানিমার সেই সফরে কলকাতার উষ্ণ অভ্যর্থনা নাকি ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায়েরই সূচনা করে। ছাদখোলা গাড়িতে বসে থাকা রাজ্যপাল পদ্মজা নায়ডুর পাশে দাঁড়িয়ে সাদা দস্তানা ঢাকা হাত নাড়তে নাড়তে রাজভবনমুখী গোটা পথটা পেরোন রানি এলিজ়াবেথ। সে-সব আজ ৬১ বছরেরও আগের কথা।
ছবির মতো সময়টা মনে পড়ছিল দক্ষিণ কলকাতার এক প্রবীণ নারীর। চুনী গোস্বামীর স্ত্রী বাসন্তী তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। তখনও বিয়ে হয়নি। তবে রানি আসার আগের দিনটায় বিশেষ বন্ধু চুনীর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে রেসকোর্সের দিকটায় এসেছিলেন। সময়টা ১৯৬১র ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ বা মার্চের শুরু। রানির সফর উপলক্ষে আলো ঝলমলে সাজে সেজেছিল রেসকোর্স। সে-দিকে তাকিয়ে খুবই উত্তেজিত ভাবে রাজভবনে রানির সঙ্গে আসন্ন সাক্ষাৎ নিয়েই চুনী কথা বলছিলেন। তখন মোহনবাগানের অধিনায়ক চুনী। মোহনবাগান দল সে-সময়ে পূর্ব আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল। কিন্তু রানির অনুষ্ঠানের জন্যই অধিনায়ক চুনী কয়েক দিন বাদে দলের সঙ্গে যোগ দেন। রাজভবনে রানি ও প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে মোলাকাতের জন্য বাছাই অতিথিদের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার তিন জন কালজয়ী ক্রীড়া নক্ষত্র। চুনী গোস্বামী, পঙ্কজ রায় এবং লেসলি ক্লডিয়াস।
কলকাতায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে চুনী গোস্বামী। আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বাসন্তীর মনে আছে, চুনির প্রিয় বন্ধু তখনকার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিলিয়ার্ডস খেলোয়াড় সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভাটুদা-র গাড়িতেই রাজভবনে রানির সম্মানে সান্ধ্য আসরে গিয়েছিলেন চুনী । মোহনবাগান তথা ভারতের ফুটবল অধিনায়ক কী পরে যাবেন, গরদের ধুতি, পাঞ্জাবিতে বাঙালিবাবু না সুট-টাইপরা সাহেব সাজবেন তা নিয়ে চিন্তায়ও ছিলেন। শেষে ভাটুদাই পরামর্শ দেন, তুই বরং পাগড়ি চাপকান চাপিয়ে ভারতীয় মহারাজা সেজে যা! শেষমেশ অত দূরও অবশ্য এগোননি ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল নক্ষত্র। তবে ভাটুদা-র থেকে প্রিন্সকোট ধার করে সেজেগুজে রানি সন্দর্শনে যান। চুনী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেওছেন, কুইনের সঙ্গে ফুটবলার বলে নিজের পরিচয় দিয়ে করমর্দন করতে হয়েছিল। আর তখনই রানির সামনে এ দেশের অভ্যাগতদের মধ্যে জনৈক চিত্রতারকার কাণ্ডে অনেকেই মুখ টিপে হেসেও ফেলেন। ওই চিত্রতারকা থেমে থেমে ‘আমি অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক’ ইত্যাদি বলে নিজের গুণপনার বিস্তারিত পরিচয় দিচ্ছিলেন। তখন নাকি প্রিন্স ফিলিপ সকৌতুক জিজ্ঞেস করেন, ‘হোয়াট এলস আর ইউ (আপনি, আরও কিছু ) ?’
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফর সেরে সে-বার কলকাতায় আসেন রানি এলিজ়াবেথ। সে-যাত্রা ব্রিটেনের সহযোগিতায় দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার কর্মকাণ্ডও এ দেশের এগিয়ে চলার স্মারক হিসেবে রানিকে দেখানো হয়েছিল। পরে দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টের অতিথিশালার নামই হয়ে যায় রানিকুঠি। কলকাতায় একটি ‘ভারতীয় কৃষি প্রদর্শনী’ও দেখতে যান এলিজ়াবেথ। এবং কিছুটা সময় কাটান রেসকোর্সে রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে। কলেজ স্ট্রিটের বাসিন্দা ৮৫ বছরের মাধব চট্টোপাধ্যায় ধর্মতলার ভিড়ে তিন ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রানিকে এক ঝলক দেখেন। কলকাতার বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা শহরের রাস্তায় সাদা দস্তানা হাতে টুপিতে সুসজ্জিতা রানি এলিজ়াবেথের ছবিটা এখনও গুটিকয়েক প্রবীণের চোখে লেগে।