রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা। শপথ গ্রহণের পর। ছবি: পিটিআই।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনে করেন, অন্য সব কারণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল মন্ত্রকের কাজের মূল্যায়ন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় গত দু’মাস ধরে প্রত্যেক মন্ত্রীর রিপোর্ট কার্ড তৈরি করে। আর তার ভিত্তিতেই মন্ত্রীদের রদবদল হয়েছে। যদিও নরেন্দ্র মোদী কোনও পূর্ণমন্ত্রীকেই খারাপ কাজের শাস্তি হিসাবে মন্ত্রিসভা থেকে সম্পূর্ণ বহিষ্কার করেননি। যেমনটা করেছেন পাঁচ জন প্রতিমন্ত্রীর ক্ষেত্রে।
ছ’মাস আগে এক বার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী তৎকালীন টেলিকমমন্ত্রী রবিশঙ্করকে তিরস্কার করেন কল ড্রপ সমস্যার জন্য। তিনি বলেন, ‘‘আমরা মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতারাই মোবাইল ফোনে কল ড্রপ সমস্যায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি। তা হলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে?’’ রবিশঙ্কর সতীর্থ মন্ত্রীদের সামনে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বলেন, ‘‘অফিসারেরা আমার কথা শুনছেন না। ওঁদের বলা সত্ত্বেও ওঁরা ওই কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।’’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অফিসারদের দিয়ে কাজ না করাতে পারাটাও কিন্তু মন্ত্রীর ব্যর্থতা। সে দিনই রবিশঙ্কর অশনি সঙ্কেত অনুভব করেছিলেন। তিনি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু টেলিকম সংস্থাগুলি আদালতে গিয়ে স্থগিতাদেশ পায়।
মন্ত্রিসভার এই রদবদলের কয়েক দিন আগে দফতরভিত্তিক মূল্যায়নের ম্যারাথন বৈঠকে আবার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় টেলিকম মন্ত্রকের কাজের তীব্র সমালোচনা করে। রবিশঙ্কর বুঝে গিয়েছিলেন এই মন্ত্রকে আলবিদা বলার সময় এসেছে। ভয় ছিল বরখাস্ত হওয়ার। ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ ছিল, নেপথ্যে অরুণ জেটলি কলকাঠি নাড়ছেন। রবিশঙ্করকে টেলিকম থেকে সরালেও মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেননি মোদী। বিহারের লব্ধপ্রতিষ্ঠ এই কায়স্থ আইনজীবী নেতাকে উল্টে ফিরিয়ে দেওয়া হল আইন মন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী রবিশঙ্করকেই আইনমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু তখন বিচারপতি নিয়োগ এবং সুপ্রিম কোর্টের নানা মামলায় সরকারের ব্যর্থতায় দায় নিয়ে তাঁকে সরে যেতে হয়েছিল। অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির সঙ্গেও রবিশঙ্করের বিবাদ ছিল তার অপসারণের আর একটি কারণ। কিন্তু কর্নাটকের ইয়েদুরাপ্পা বিরোধী নেতা সদানন্দ গৌড়াকে আইনমন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে তার পরিণতি যে আরও ভয়ানক হল সেটা দু’বছরে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন মোদী। পরিসংখ্যানের মতো কার্যত কর্মহীন দফতরে গৌড়াকে পাঠিয়ে দিলেন। রবিশঙ্করের জায়গায় নিয়ে এলেন মনোজ সিনহাকে। উত্তরপ্রদেশের এই ভূমিহার নেতাটি রেলমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দাপটে কাজ করে সকলের নজর কেড়েছেন। উত্তরপ্রদেশের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নামও অনেকে প্রস্তাব করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই মনোজ সিনহাকে টেলিকমে স্বাধীন দায়িত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এ বার টেলিকম সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী সারসরি নামছেন। মনোজ সিনহা হবেন তাঁর ফ্রন্টম্যান।
আমদাবাদ থেকে এসে গুজরাত ভবনে আস্তানা গেড়ে যখন নরেন্দ্র মোদী প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তখন মোদীর কাছে নর্থ ব্লক-সাউথ ব্লকের প্রশাসন ছিল অনেকটাই অপরিচিত। আমলাদের ব্যক্তিগত ভাবে অনেককেই চিনতেন না। তখন দিল্লির রাজনীতিটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহকর্মী অরুণ জেটলির হাত ধরেই কিন্তু করতে চেয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রকের পাশাপাশি তথ্যমন্ত্রকেরও দায়িত্ব অরুণকে দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন সর্বভারতীয় অভিজাততন্ত্র এবং বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে অরুণ জেটলিকে সেতু করে সম্পর্ক স্থাপন করবেন। সর্বভারতীয় নাগরিক সমাজের কাছে গোধরার কলঙ্ক মুছে এক নতুন অধ্যায় শুরু করবেন। কিন্তু এই দু’বছর পর ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে বসে যে রদবদলটি মোদী করলেন সেটিতে মোহন ভাগবতের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া থাকলেও অন্য কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকী, জেটলিরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। নরেন্দ্র মোদী দু’বছরে নিজেকে অনেকটাই সুসংহত করে ফেলেছেন। রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, সবার উপরে লালকৃষ্ণ আডবাণীর ক্ষোভ-বিক্ষোভকে দু’বছরে অনেকটাই প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় কেউ নেই। আর তাই অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলিকে অনেকটা স্বস্তি দিয়েছেন। জয়ন্ত সিনহার মতো ব্যক্তিত্বকে নর্থ ব্লক থেকে সরিয়ে অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকে প্রতিমন্ত্রী করে দিয়েছেন। জয়ন্ত সিনহা নিজে প্রাক্তন অথর্মন্ত্রী যশবন্ত সিনহার পুত্র। যে যশবন্ত সিনহার সঙ্গে সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর ছিল না। জয়ন্ত ম্যাকেঞ্জিতে কাজ করে আসা, তিনি রঘুরাম রাজনের বন্ধুও। অর্থমন্ত্রকে ক্রমশই তিনি হাই প্রোফাইল নেতা হয়ে অরুণের সমান্তরাল হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে সরিয়ে যাকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে, তার থেকেই বোঝা যায় ,অরুণের পক্ষে এর ফলে কাজ করাটা অনেক সহজ হবে। আবার বিমানমন্ত্রকের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অশোক গজপতি রাজু এনডিএ শরিক দলের (তেলুগু দেশমের) নেতা। তার নীচে সিনহাকে রাখায় প্রধানমন্ত্রীরও আবার বিমানমন্ত্রকে নজর রাখতে সুবিধা হবে।
আরও পড়ুন: বেখেয়ালেই এমন নিখুঁত মিলে গেল অঙ্কটা?
অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলিকে স্বস্তি দিলেও প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় মন্ত্রী পদ থেকে বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে সরিয়ে দিয়ে দিলেন অনন্ত কুমারকে। সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কর্নাটকের ব্রাহ্মণ নেতা অনন্তকুমার ঘোরতর জেটলি বিরোধী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মূল্যায়ন— বেঙ্কাইয়া সংসদীয় মন্ত্রী হিসাবে অসফল। কিন্তু অনন্ত কুমারকে সফল হবে। কারণ অনন্ত কুমার ছিলেন প্রমোদ মহাজনের চ্যালা। প্রমোদ মহাজন ঠিক যে ভাবে সংসদীয় মন্ত্রীর কাজ করেছেন সেটা অনন্ত কুমার তাঁর অধীনে প্রতিমন্ত্রী হয়ে অতীতে শিক্ষা নিয়েছিলেন। সব দলের নেতাদের সঙ্গে অনন্ত কুমারের বন্ধুত্ব সুবিদিত। আবার অরুণের তথ্যমন্ত্রক নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার একটি কারণ হল অরুণ নিজেই তথ্যমন্ত্রক রাখতে চাইছিলেন না। বাজপেয়ী জমানায় তিনি এক বার তথ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবং তাঁর নিজের তথ্যমন্ত্রক সম্পর্কে সিনিক্যাল মত আছে। সেটা হল ভগবানেরও সাধ্য নেই প্রসার ভারতীর সংস্কার করে। যেমন, এয়ার ইন্ডিয়া এবং বিএসএনএল-কে উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। বেঙ্কাইয়া কোনও সর্বভারতীয় মুখ নন। অরুণের মতো দিল্লির মুখ নন। সংবাদপত্র্র মালিকদের বন্ধু বলেও পরিচিত নন। প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি, এ হেন ব্যক্তি সরকার এবং সংবাদমাধ্যমের সেতু রচনার জন্য বেশি উপযুক্ত। আবার বেঙ্কাইয়ার কাছ থেকে নগরোন্নয়ন না নিয়ে বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে তথ্যমন্ত্রক দেওয়ায় এক লহমায় বেঙ্কাইয়ার গুরুত্ব বেড়ে গেল। যেমন দায়িত্ব বাড়ল প্রকাশ জাভরেকরের। পীযুশ গোয়েল এবং ধর্মেন্দ্র প্রধান আশা করলেও নাগপুর তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। প্রকাশ জাভরেকরকে স্মৃতি ইরানির বিকল্প হিসাবে বেছে নেওয়া হল। তাতে শিক্ষামন্ত্রকে আরএসএস-এর কর্মসূচি রূপায়ণে কোনও বাধা হবে না। বরং স্মৃতি ইরানির চেয়ে সফল ভাবে বেশি ঢাকঢোল না পিটিয়ে প্রকাশ্যে কাজটা করবেন বলে মনে করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও পুরো মন্ত্রিসভার রদবদল যে কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে তিনি করতে পেরেছেন, এমনটা বলা যায় না। রদবদলে অরুণ জেটলির উপরে নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা আছে, জেটলি বিরোধী নেতা অনন্তকুমার থেকে বিজয় গয়ালদের ঠাঁই দিয়ে তিনি রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ নেতা কলরাজ মিশ্রকে চাইলেও ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী সরাতে পারেননি। আর সেই একই কারণে বয়সের লক্ষণরেখা অতিক্রম হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কলরাজকে রাখায় নাজমাকে বিদায় জানানোও সম্ভব হল না। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাজ নিয়েও নালিশ অনেক। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের চাপে নাড্ডারও দফতর বদল সম্ভব হয়নি। যেমন সম্ভব হয়নি জাতপাত এবং সামাজিক কারণকে মাথায় রেখে ভোটের আগে বেশ কিছু নতুন প্রতিমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া।
এক কথায় বলা যায়, নরেন্দ্র মোদী এ বার বাদল অধিবেশনের আগে চেয়েছেন সরকারে দু’বছর পর নতুন গতি আনতে। দু’বছরের তৈরি হওয়া জীর্ণতায় আঘাত হানতে। কিন্তু যতটা সাহসী সংস্কার তিনি আসলে মনে মনে করতে চান, এখনও দেশের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় সে গতিতে যে কাজটি করা সম্ভব নয়, সেটাও বুঝতে পারছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই অভিমুখ এবং চেষ্টা থাকলেও তিনি সাবধানীও বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy