জেলাশাসক জলি কীর্তির কোলে শান্তি, পাশে জেলা পুলিশ সুপার মহনিশ মিশ্র। ছবি সংগৃহীত।
ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ তুলে প্রাণপনে ছুটে চলেছে একটা হলুদ কালো অটো। কাঁচা রাস্তা ছেড়ে পিচ রাস্তা ধরে হাইলাকান্দি টাউনের দিকে। সুনসান রাস্তা। পাড়া-বসতি থমথমে। নিস্তব্ধ রাস্তায় আওয়াজ বলতে শুধু সেনা-পুলিশের ভারী বুটের শব্দ!
ছুটতে থাকা ওই অটোর কাছে থাকলে যে কেউ শুনতে পেতেন, ইঞ্জিনের যান্ত্রিক গোঙানি ছাপিয়ে অটোর পিছনের সিটে আধা শোয়া এক তরুণীর আর্তনাদ। প্রসব বেদনায় থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছেন। পাশে বসা তাঁর যুবক স্বামী তাঁকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আর সেই দৃশ্য দেখে অস্ফুটে ‘আল্লা’-কে ডেকে চলেছেন অটোচালক।
স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে টহল দিচ্ছেন অসম রাইফেলস-এর জওয়ানরা। গোটা এলাকা জুড়ে চলছে কারফিউ।
সাম্প্রদায়িক অশান্তির আগুন জ্বলছে অসমের ওই জেলায়। দফায় দফায় সংঘর্ষ, লুঠপাট, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে গুলি চালাতেও হয়েছে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ গিয়েছে এক যুবকের। কারফিউ ভাঙলে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ রয়েছে। তারই মধ্যে প্রাণ হাতে নিয়ে অটো চালাচ্ছেন মকবুল হোসেন লস্কর।
আরও পড়ুন: গাঁধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক ছিলেন, থাকবেন! ফের বিতর্কিত মন্তব্য প্রজ্ঞার
হাইলাকান্দি জেলা শহর থেকে বড়জোর পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাজ্যেশ্বরপুর পার্ট-১ গ্রামে বাড়ি তাঁর। রবিবারের দুপুর। অশান্তির মধ্যে অন্যদের মতো বাড়িতেই ছিলেন তিনি। আর তখনই খবর পেলেন নন্দিতার। মকবুলের বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি দূরেই থাকেন রুবন দাস এবং তাঁর স্ত্রী নন্দিতা। তিনি সন্তানসম্ভবা। রবিবার দুপুরেই হঠাৎ শুরু হয়ে যায় তাঁর প্রসব যন্ত্রণা। রুবন আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সবাইকে ফোন করে চলেছেন। স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অশান্তির ভয়ে কেউই ভরসা পাচ্ছেন না কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামতে। একের পর এক ফোন করে যখন কোনও আশাই দেখতে পাচ্ছেন না রুবন তখনই রুবনের ওই অবস্থার কথা জানতে পারেন মকবুল।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে মকবুল বলেন, ‘‘তখন বাকি বিপদের কথা মাথায় আসেনি। বাড়ি থেকে অটো বার করে রুবন আর তাঁর স্ত্রীকে তুলি। তার পর যতটা জোরে পারা যায় অটো চালাতে থাকি।’’ নন্দিতার অবস্থা দেখে ঘাবড়েই গিয়েছিলেন মকবুল। বুঝতে পারছিলেন না ঠিক সময়ের মধ্যে টাউনের এস কে রায় সিভিল হাসপাতালে পৌঁছতে পারবেন কি না? স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানান, তিনি শুধু আল্লার নাম করছিলেন। বড় রাস্তার উপর উঠতেই তাঁর মনে পড়ে কারফিউ চলছে। আধা সেনা যে কোনও সময় গুলি চালাতে পারে।
আরও পড়ুন: ‘যোগী আদিত্যনাথ’-এর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট সারলেন অখিলেশ!
তারপরেও দমে যাননি। প্রাণ হাতে করেই নন্দিতাকে নিয়ে পৌঁছন হাসপাতালে। রবিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নন্দিতা জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। আর সেটাই এখন মকবুল-রুবনদের গোটা পাড়ার পাওনা। বাড়ি ফেরার পর নন্দিতা-রুবন ছেলের নাম দিয়েছেন ‘শান্তি’। এস কে রায় সিভিল হাসপাতালের প্রশাসক ভাস্কর দাস সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,‘‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ এক অনন্য উদাহরণ।”
শান্তির জন্মের খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। খবর পেয়েই শান্তিকে দেখতে যান জেলাশাসক জলি কীর্তি এবং জেলা পুলিশ সুপার মহনিশ মিশ্র। শান্তিকে কোলে নিয়ে জেলাশাসকের আশা,‘‘শান্তির জন্মের এই খবরই গোটা জেলা জুড়ে ফিরিয়ে আনবে শান্তি।”
এখনও হাইলাকান্দিতে দফায় দফায় কারফিউ আছে। কিন্তু রবিবারের পর থেকে অশান্তির খবরও আর পাচ্ছে না জেলা প্রশাসন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy