Advertisement
E-Paper

নিজের দেশেই ব্রাত্য! এখন কোথায় যাব?’ বিধায়ক-পুত্রের নিদানে ইনদওরের বাজারে কাজ হারাতে চলেছেন মুসলিমেরা

মাস দুয়েক আগে মুসলিমদের দোকান ছেড়ে চলে যাওয়ার নিদান দিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক-পুত্র তথা ইনদওর বিজেপি-র সহসভাপতি একলব্য গৌর। মুসলিম সম্প্রদায়কে চিরকালের মতো এলাকা ছাড়ার জন্য সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন তিনি। খানিকটা হুঁশিয়ারির সুরেই জানিয়েছেন, ২৫ অক্টোবরের পর বাজারে থাকবেন না একজনও মুসলিম!

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ২২:৫৯
মুসলিম সম্প্রদায়কে চিরকালের মতো এলাকা ছাড়ার নিদান দিয়েছেন ইনদওর ৪-এর বিধায়ক মালিনী গৌরের ছেলে একলব্য গৌর।

মুসলিম সম্প্রদায়কে চিরকালের মতো এলাকা ছাড়ার নিদান দিয়েছেন ইনদওর ৪-এর বিধায়ক মালিনী গৌরের ছেলে একলব্য গৌর। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ইনদওরের শীতলা মাতা বাজার। মধ্যপ্রদেশের অন্যতম বড় পোশাক বাজার এটিই। দশকের পর দশক ধরে সেখানে মিলেমিশে ব্যবসা করছেন হিন্দু-মুসলিম দোকানদার ও কর্মীরা। বা, করতেন। কারণ, এত দিন তেমনটাই ছিল দস্তুর। কিন্তু সম্প্রতি চিত্রটা এক লহমায় অনেকটা বদলে গিয়েছে। গত এক মাসে তিনপুরুষের দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন শয়ে শয়ে মুসলিম। যাঁরা হিন্দু মালিকদের অধীনে কাজ করতেন, চাকরি খুইয়েছেন তাঁরাও। আকাশছোঁয়া ঋণের বোঝা যেমন কাঁধে চেপেছে, তেমনই শুরু হয়েছে নতুন জীবিকার খোঁজ— সব মিলিয়ে ঘোর সঙ্কটে এলাকার সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীরা।

গত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গমগম করত ইনদওরের এই বাজার। মূলত হিন্দু মালিকদের দোকানে কাজ করতেন মুসলিম বিক্রেতা, দর্জি ও অন্য কর্মীরা। কিন্তু ধর্ম আলাদা হলেও সম্প্রীতির অভাব ছিল না। সেই সম্প্রীতিই এক রকম ভাবে টিকিয়ে রেখেছিল কাপড়ের এই বাজারকে। মুসলিমদের কারও কারও নিজস্ব দোকানও ছিল। কিন্তু এখন নেই। কারণ, মাস দুয়েক আগেই মুসলিমদের দোকান ছেড়ে চলে যাওয়ার নিদান দিয়েছেন ইনদওর বিজেপি-র সহসভাপতি একলব্য গৌর, যিনি আবার দক্ষিণপন্থী সংগঠন হিন্দু রক্ষকেরও প্রধান। মুসলিম সম্প্রদায়কে চিরকালের মতো এলাকা ছাড়ার জন্য সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন তিনি। খানিকটা হুঁশিয়ারির সুরেই জানিয়েছেন, ২৫ অক্টোবরের পর বাজারে থাকবেন না একজনও মুসলিম!

২০২১ সালে প্রথম বার খবরের শিরোনামে আসেন ইনদওর ৪-এর বিধায়ক মালিনী গৌরের ছেলে একলব্য। সে বছরের জানুয়ারিতে ইনদওরের একটি ক্যাফেতে ঢুকে মুসলিম কৌতুকাভিনেতা মুনাওয়ার ফারুকিকে শাসান তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা। মুনাওয়ারের পাশাপাশি ক্যাফের কর্মীদের বিরুদ্ধে হিন্দু দেবদেবীদের অবমাননার অভিযোগও তোলেন তাঁরা। পুলিশে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। তবে এ বারে একলব্যের নিশানায় শীতলা মাতা বাজার। তাঁর দাবি, গত দু’বছর ধরেই বাজারে একাধিক মহিলাকে হেনস্থার অভিযোগ উঠছে। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন মুসলিমরাই। তা হলে অভিযোগ দায়ের হয়নি কেন? একলব্যের ব্যাখ্যা, ‘‘মামলাগুলির প্রতিটিই বেশ সংবেদনশীল হওয়ায় ওই মহিলারা স্থানীয় বিধায়কের (তাঁর মা মালিনী) কাছে গিয়েছেন, কিন্তু পুলিশে যেতে পারেননি।’’

বিজেপি নেতা আরও দাবি করেছেন, গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন একলব্য। তাঁরাই নাকি একযোগে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে পাল্টা দু’টি অভিযোগও দায়ের করেছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়। তবে এখনও কোনও সুরাহা মেলেনি। ইনদওর রেঞ্জ ৪-এর ডিসিপি আনন্দ কালাগদি বলেন, ‘‘আমরা অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখছি। এ জন্য ডিসিপি পদমর্যাদার এক কর্তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। সব অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে।’’

এই টানাপড়েনের প্রভাব পড়েছে ব্যবসাতেও। তিনপুরুষের দোকান জলের দরে বেচে দিতে শুরু করেছেন এলাকার মুসলিমরা। কাজ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে শুরু করেছেন আরও অনেকে। আর যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদেরও অবস্থা শোচনীয়। এলাকারই ২৫ বছর বয়সি এক মুসলিম ব্যবসায়ী সম্প্রতি নিজের শাড়ির দোকান খোলার জন্য ১০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন লোকসানে সেই দোকান বেচে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। দিশেহারা যুবক সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘‘মাথায় এত ঋণের বোঝা। কী করব? নিজেরই দেশের নাগরিকদের এ ভাবে ব্রাত্য করে দেওয়া যায়? এখন আমি কোথায় যাব?’’

একলব্য যা-ই বলুন, এলাকার কতিপয় হিন্দু ব্যবসায়ীর গলায় কিন্তু ভিন্ন সুর। গৌরব নামে এক ব্যবসায়ী বলছেন, ‘‘এই হিন্দু-মুসলিম বিবাদ বাজারটাকে ধ্বংস করে দিল! এ বছর দশেরাতেও ব্যবসা চলেনি। আমাদের বাধ্য হয়ে অনেক কর্মীকে বরখাস্ত করতে হয়েছে। তেমন উদ্‌যাপনও হয়নি এ বার।’’ গৌরবের মতো বেশ কয়েক জন হিন্দু দোকানদার এই নির্দেশের বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছিলেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের বাঁচাতে বিক্ষোভও দেখিয়েছিলেন, তবে তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। বেশির ভাগ হিন্দুই নীরবে নির্দেশ মেনে নিয়েছেন— কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বা ভয়ে। কিন্তু আখেরে ক্ষতিই হয়েছে সকলের। বিষ্ণু বিজয়বর্গীয় নামে এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘ওঁরা আমাদের অন্যতম দক্ষ কর্মী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ওঁদের দেখে আসছি। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁরা তো কাজ ছেড়েছেনই, সেই সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মহিলারাও কেনাকাটা করতে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন।’’

আর মুসলিমরা? তাঁরা প্রতিবাদ করছেন না? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রৌঢ় বললেন, ‘‘আমরা এমনিতেই আতঙ্কিত। প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেলে যেতে চাই না। ১০০ বছরের পুরনো বাজার। ৪০ বছর ধরে এখানে নির্বিঘ্নে কাজ করেছি। এখন হয়তো আশপাশের বাজারে কাজ খুঁজব। শাড়ি, লেহেঙ্গার কাজটুকুই জানি। ওইটুকুই আমাদের সম্বল। এখন আর কোথায় যাব?’’

Muslims Indore market hindu BJP MLA
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy