Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পাঁচশো, হাজার অচল, চমকে দিয়ে হানা জাল ও কালো টাকায়

নিয়ন্ত্রণরেখার পরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এ বার ‘কালো টাকায়’। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিল মোদী সরকার।

জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই

জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২৯
Share: Save:

নিয়ন্ত্রণরেখার পরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এ বার ‘কালো টাকায়’। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দিল মোদী সরকার।

আজ সন্ধেয় মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর পর জাতির উদ্দেশে বেনজির বক্তৃতায় সেই ঘোষণা করেন তিনি। নাম না করে পাকিস্তানকে আক্রমণ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, সীমান্তপারে জাল নোট ছড়াচ্ছে শত্রুরা। আর দুর্নীতির কারণেও দেশ কালো টাকায় ছয়লাপ। কিছুতেই যা নির্মূল করা যাচ্ছে না। দুর্নীতিবাজদের কালো টাকা ও সন্ত্রাস-চক্রের জাল টাকা মুছে ফেলতেই আচমকা এই পদক্ষেপ করল সরকার।

এবং সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ব্যর্থতা ঢাকতেই কি মোদীর এই নয়া চমক? কেবল বিরোধী দল নয়, বিশেষজ্ঞদের অনেকেও বলছেন, ‘অচ্ছে দিন’ আনার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েই কি মোদী এখন নতুন চমক দেখাতে চাইছেন? মোদীর সেনাপতি, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কথায়, ‘‘কালো টাকার অর্থনীতির উপরে এত বড় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক অতীতে কোনও দিন হয়নি।’’ ভোটের আগে কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে সরব হতেন যিনি, সেই যোগগুরু রামদেবও আজ মোদীর ‘পরাক্রম’ দেখে উচ্ছ্বসিত। সমালোচকরা কটাক্ষ করছেন যে, আসল কাজে সফল হননি, সেটা বুঝতে পেরেই মোদী ও তাঁর সহযোগীরা এত নাটক করছেন।

সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে ১০ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁর কাছে যত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট আছে, সেগুলি ব্যাঙ্কে বা ডাকঘরে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিতে পারেন। অথবা ২৪ নভেম্বরের মধ্যে যে কোনও ব্যাঙ্কে বা ডাকঘরে পরিচয়পত্র দেখিয়ে ‌সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দিয়ে নতুন নোট সংগ্রহ করে নিতে পারেন। ২৫ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ৪ হাজার টাকার সীমা বাড়ানো হবে।

সরকার হাজার টাকার নোট পাকাপাকি ভাবে তুলে দিয়ে ২ হাজার টাকার নোট বাজারে আনছে। আগে যা ছিল না। ছাড়া হবে নতুন ৫০০ টাকার নোটও। নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোটের নমুনাও আজ জনসমক্ষে তুলে ধরেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। আগামিকাল ও পরশু দু’দিন এটিএম পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। কাল সব ব্যাঙ্কও বন্ধ থাকবে। তবে চেক, ডিমান্ড ড্রাফট, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড, ইলেকট্রনিক লেনদেনে কোনও বিধিনিষেধ থাকছে না।

এটিএমে টাকা তোলার লাইন। মঙ্গলবার ধর্মতলায় সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

তবে হঠাৎ করে নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে এমন আকস্মিক ঘোষণায় আমজনতার হয়রানি কিছুটা কমানোর জন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন দিন সরকারি হাসপাতালে, ওষুধ কেনাবেচায়, বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট কেনার ক্ষেত্রে পুরনো নোট ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এর পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ভাবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিশ্চিত। সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দেশ থেকে কালো টাকা ও জাল নোট উধাও করার জন্য এইটুকু ভোগান্তি দেশবাসী সহ্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস।’’

সমালোচকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নিত্যনতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করছেন বটে, কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়িত করতে গিয়ে একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছেন। ‘অচ্ছে দিন’ তো আসেইনি, উল্টে বেহাল দশা অর্থনীতির। বিদেশনীতিও ধাক্কা খেয়েছে। তার উপর দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও চাপের মুখে মোদীর দল ও সরকার। ক’দিন আগে সেনা অভিযান নিয়ে উত্তরপ্রদেশের ভোটে ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন মোদী, অমিত শাহরা। তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। দলিত ও সংখ্যালঘু নিগ্রহ চলছে, এক পদ এক পেনশনের ঠিকঠাক বাস্তবায়ন
না হওয়ায় আত্মহত্যা করছেন প্রাক্তন জওয়ান। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে নিরন্তর। এ সব পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা ঢাকতে ও নজর ঘোরাতেই তুঘলকি দাওয়াই দিচ্ছেন মোদী। বিরোধী শিবিরের কারও কারও টিপ্পনি, মোদী এ বার আমেরিকার নির্বাচন ঘিরে আগ্রহকেও টেক্কা দিতে চাইছেন! কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি এ দিন বলেন, ‘‘মহম্মদ বিন তুঘলকের আত্মা জেগে উঠেছে! এ বারে রাজধানীও দৌলতাবাদে চলে যাবে!’’ কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘লোকসভা ভোটের আগে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক খাতায় ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই মানুষটি। কিন্তু দেশে ও বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ঘোষণা করার প্রকল্পেও প্রত্যাশামাফিক সাড়া মেলেনি। যার ফলে সরকার এখন নোটই তুলে নিচ্ছে বাজার থেকে!’’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মোদী একটি ঝুঁকিও নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ছোট এবং অনেক ক্ষেত্রে মাঝারি ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়বেন। কারণ, তাঁদের কারবারে লেনদেন মূলত হয় নগদ টাকায়
এবং সেই লেনদেনে ৫০০ টাকার নোটের বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে। এই ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সমর্থন বিজেপির একটা বড় খুঁটি, সুতরাং নোট বাতিলের ফলে তাঁরা মোদীর প্রতি অসন্তুষ্ট হলে দলের ক্ষতি। একই সঙ্গে, বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা প্রকাশ্যে দুর্নীতি দমনের এই উদ্যোগকে সমর্থন
জানালেও এর ফলে বাজারে যে টালমাটাল দেখা দেবে, অনেকেই তা নিয়ে শঙ্কিত।

নতুন অর্থশাস্ত্র

•মঙ্গলবার মধ্যরাত্রি থেকেই বাজারে অচল হল এখনকার ৫০০, ১০০০ টাকার নোট

•সরকারি হাসপাতাল এবং রেল-সরকারি বাস-বিমানবন্দরের টিকিট কাউন্টারে তা চলবে শুক্রবার মধ্যরাত্রি পর্যন্ত

• শুক্রবার পর্যন্ত নোট দু’টি চলবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পেট্রোল পাম্প, সরকারি সমবায়িকা, রাজ্য সরকারি দুধের বুথ, শ্মশান, কবরস্থানে

•বুধবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। বুধ ও বৃহস্পতিবার বন্ধ এটিএম-ও

• তার পরে প্রথম কয়েক দিন এটিএম থেকে ২০০০ টাকা করে তোলা যাবে প্রতিদিন। পরে তা বেড়ে হবে ৪০০০

•আপাতত সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে তোলা যাবে দিনে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহে ২০,০০০

• ১০০ টাকা পর্যন্ত সব নোট চালু থাকছে। বাধা নেই চেক, ডিমান্ড-ড্রাফ্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড এবং নেট ব্যাঙ্কিংয়ে

* কোনও ক্ষেত্রেই সময়সীমা স্পষ্ট জানা যায়নি এখনও

দেশ থেকে কালো টাকা ও জাল নোট উধাও করার জন্য এইটুকু ভোগান্তি দেশবাসী সহ্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

নরেন্দ্র মোদী, প্রধানমন্ত্রী

কিন্তু এ ভাবে এক ঝটকায় বড় অঙ্কের দু’রকম নোটই তুলে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী?

অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, জাল নোট পুরো বাজারে ছেয়ে গিয়েছে। মূলত পাকিস্তানেই ভারতের জাল নোট ছাপা হয়। ভারতের টাকার সঙ্গে তার এতটাই মিল যে, সাধারণ মানুষ ধোঁকা খান অনায়াসে। তাই নতুন ৫০০ ও ২ হাজার টাকার নোট বাজারে আনা হচ্ছে। যেটি জাল করা মুশকিল। দীপাবলির সময়ও প্রচুর জাল নোট ভারতের বাজারে এসেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেল অবশ্য বলেন, ‘‘দেশের টাকা ছাপার পদ্ধতিতে কোনও হেরফের হয়নি। তবে পুরো বিষয়টি গোপনীয়
রেখেই নতুন ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা হয়েছে।’’

নতুন ৫০০ এবং ২০০০ টাকার নোট।

সরকার গোটা বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলেও নতুন ২ হাজার নোটের ছবি আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে এসেছে। তা হলে কি সরকারিতন্ত্রেও সিঁধ কেটেছেন কেউ?

জবাবে আর্থিক বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাস বলেন, ‘‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। হতে পারে, অনেক দিন ধরেই এই প্রক্রিয়া চলছে। অনেক মাস আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড নতুন ২ হাজার টাকা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হতে পারে কেউ মোবাইলে ফটো তুলে নিয়েছেন। কিন্তু নতুন নোট জাল করা কঠিন।’’ কতটা কঠিন, সেটা অবশ্য ভবিষ্যৎই বলবে।

আগেও বন্ধ বড় নোট

এই প্রথম নয়। আগেও বড় নোট বন্ধ হওয়ার সাক্ষী থেকেছে ভারত। মূলত ১৯৪৬ এবং ১৯৭৮ সালে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ভারতে প্রথম বার ১০,০০০ টাকার নোট চালু হয় ১৯৩৮ সালে। চালু ছিল ১,০০০ টাকাও। দু’টিই বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে। আবার ১৯৫৪ সালে নতুন করে আনা হয় ১ হাজার, ৫ হাজার এবং ১০ হাজারের নোট। কিন্তু সেগুলি ফের বাজার থেকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয় ১৯৭৮ সালের প্রথম মাসে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে পুরদস্তুর চালু হয় ৫০০ টাকার নোট। আর ২০০০ সালের নভেম্বরে ফেরে হাজারের নোট। মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে দেশে টাকার জোগান কমানোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত বলে তখন জানিয়েছিল কেন্দ্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

black money surgical strikes Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE