Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সংস্কার চাই, মোদীকে বার্তা শিল্পপতিদের

এ বার কাজ হোক। ‘কথা অনেক হল’ না বলেও মঙ্গলবারের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে এই বার্তাই দিয়ে এল শিল্পমহল। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বরাবর শিল্পবন্ধুর তকমা সেঁটে থেকেছে মোদীর গায়ে। বলা হয়েছে, এ দেশে শিল্পের নাড়ি বুঝতে তিনি অদ্বিতীয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

এ বার কাজ হোক।

‘কথা অনেক হল’ না বলেও মঙ্গলবারের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে এই বার্তাই দিয়ে এল শিল্পমহল।

গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বরাবর শিল্পবন্ধুর তকমা সেঁটে থেকেছে মোদীর গায়ে। বলা হয়েছে, এ দেশে শিল্পের নাড়ি বুঝতে তিনি অদ্বিতীয়। অথচ প্রধানমন্ত্রীর মসনদে পনেরো মাস যেতে-না-যেতে সেই তাঁর সামনেই উদ্বেগ উগরে দিল শিল্পমহল। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ডাকা বৈঠকে দেশের তাবড় শিল্পপতিদের দাবি, থমকে যাওয়া সংস্কারের চাকায় যে ভাবে হোক গতি ফেরাক সরকার। আলগা হোক লাল ফিতের ফাঁস। কমুক সুদের হারও। একমাত্র তবেই লগ্নি করতে ভরসা পাবেন তাঁরা। অর্থনীতির ঘোড়া দৌড়বে পুরোদমে। এক কথায়, এত দিন যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, এ বার তা কাজে করে দেখাক কেন্দ্র।

রাতারাতি এই সমস্ত দাবি পূরণ যে সম্ভব নয়, তা বিলক্ষণ জানেন মোদী। হয়তো সেই কারণে সব সমস্যা এখনই মিটিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতিও দেননি তিনি। বরং পাল্টা বল পাঠাতে চেয়েছেন শিল্পমহলের কোর্টে। আহ্বান জানিয়েছেন, কিছুটা ঝুঁকি নিয়েও লগ্নি করতে। আশ্বাস দিয়েছেন, বিশ্বজোড়া অস্থিরতার আঁচ এ দেশের গায়ে সে ভাবে লাগবে না।

চিনের টালমাটাল অর্থনীতি, তাদের মুদ্রা ইউয়ানের দাম কমা, মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভের সুদ বাড়ানোর সম্ভাবনা এবং ভারতের উপর এই সব কিছুর প্রভাব। মূলত এই বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই এ দিন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার এবং অর্থনীতিবিদদের নিজের বাড়িতে ডেকেছিলেন মোদী। উপস্থিত ছিলেন, মুকেশ অম্বানী, সাইরাস মিস্ত্রি, সুনীল মিত্তল, কুমারমঙ্গলম বিড়লা, সুমিত মজুমদারের মতো শিল্পপতি। অরুন্ধতী ভট্টাচার্য, ছন্দা কোছরের মতো ব্যাঙ্কিং কর্ণধার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। ছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন, নীতি আয়োগের ডেপুটি চেয়ারম্যান অরবিন্দ পানাগড়িয়া প্রমুখও। প্রায় তিন ঘণ্টার বৈঠকে কথা হয় দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়েই।

এই বৈঠকেই শিল্পমহলের অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি)— আটকে রয়েছে সংস্কারের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল। জমি বিল নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেও বিহার-ভোটের মুখে শেষমেশ পিছিয়ে গিয়েছে কেন্দ্র। আর সংসদে রাজনীতির লড়াইয়ের কারণে তীরে এসেও তরী ডুবেছে জিএসটির। তাদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে বিকল্প পথ খুঁজুক সরকার। দেখুক, সংসদে আটকে থাকা সংস্কারের বিল রাজ্যের মাধ্যমে কার্যকর করা যায় কি না। ঠিক যে ভাবে রাজ্যগুলিকে এখন নিজেদেরই জমি আইনে বদল করার কথা বলা হচ্ছে।

একই সঙ্গে শিল্পমহলের চাহিদা, অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে কৃষিতে লগ্নি বাড়ানোর পথ প্রশস্ত হোক। সেচে লগ্নির অঙ্ক বাড়ুক। যাতে গ্রামের মানুষের আয় বাড়ে। আর তার হাত ধরে বাড়ে বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা। একই সঙ্গে, শিল্প-সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে শ্রম আইন সংস্কার, আটকে থাকা প্রকল্প চালু, দেউলিয়া আইন সংশোধন, দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন ইত্যাদিতে জোর দিক সরকার। দ্রুত লগ্নির ছাড়পত্র পেতে আলগা হোক লাল ফিতের ফাঁসও। শিল্পমহলের মতে, একমাত্র তবেই কাজে আসবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্কিল ইন্ডিয়া’র মতো প্রকল্প। নইলে তা স্রেফ নজরকাড়া ঘোষণা হয়েই থেকে যাবে।

রাজনকে সামনে পেয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই সুদ কমানোর দাবি তুলেছে শিল্পমহল। তাদের যুক্তি, তাতে এক দিকে চাহিদা যেমন বাড়বে, তেমনই খরচ কমবে মূলধন জোগাড়েরও। বিশ্ব বাজারে তেলের দর তলানিতে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে। রাশ টানা গিয়েছে রাজকোষ ঘাটতিতেও। অনেক শিল্পপতিই মনে করেন, এই পরিস্থিতিতেও যদি সুদ কমানো না যায়, তবে তা আর কমবে কবে? শিল্পমহলের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়েও লগ্নি করুক তারা। কারণ, মাপা ঝুঁকি নিয়ে টাকা ঢালায় শিল্পপতিদের যে দক্ষতা রয়েছে, সরকারের তা নেই। কাজেই কর্পোরেট সংস্থাকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতেই হবে বলে মনে করেন তিনি।

আসলে মোদী সরকার মনে করে, চিনা অর্থনীতির গতি ঢিমে হওয়ার আশঙ্কায় ভারতের শেয়ার বাজার টলমল করছে ঠিকই। কিন্তু সেই অস্থিরতা সাময়িক। বরং তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল বা পণ্যের দাম কমলে, আখেরে লাভ ভারতীয় অর্থনীতিরই। কারণ, একে ভারতের বাজার যথেষ্ট বড়। তার উপর এ দেশের অর্থনীতি রফতানি নির্ভরও নয়। ফলে চিনের অর্থনীতির প্রাচীরে ফাটল দেখা দিলে, সেখান থেকে লগ্নি সরতে পারে। আরও বেশি বিনিয়োগ আসতে পারে এ দেশে।

এ দিনের তিন ঘন্টার বৈঠকে সেই যুক্তি দিয়েই মোদী শিল্পমহলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, চিনের সমস্যা বা আমেরিকায় সুদ বাড়ার প্রভাব এ দেশে সে ভাবে পড়বে না। ভারতের অর্থনীতির ভিত মজবুত। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে বরং সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন তাঁরা। এর সপক্ষে উদাহরণ তুলে ধরতে বলা হয়েছে ফক্সকন, লেনোভো, সিমেন্স, জিএম কিংবা জিয়াওমির কথা। সম্প্রতি ভারতে মোটা বিদেশি লগ্নির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যারা। কেন্দ্রের যুক্তি, কারখানা গড়তে মোটা টাকা ঢালতে বিদেশি সংস্থা যদি আস্থা রাখতে পারে, তবে এ দেশের বেসরকারি ক্ষেত্র তা পারবে না কেন? একই সঙ্গে মোদী সরকারের আশ্বাস, লগ্নির পথ মসৃণ করতে পরিকাঠামোয় খরচ বাড়াবে তারা। তৈরি করবে লগ্নি সহায়ক পরিবেশ। যে সব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, সুবিধা দেবে সেখানে লগ্নিতে। জেটলিও বলেন, ‘‘সরকারি খরচে বৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি লগ্নির গতি বাড়া জরুরি।’’

৭ রেসকোর্স রোডের বাসিন্দা হওয়ার পরে শিল্পমহলের সঙ্গে এ’টি প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বৈঠক। আগেরটি হয়েছিল ৩০ জুন। খাতায়-কলমে আলোচনার বিষয় ছিল, ‘সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি— ভারতের সামনে সুযোগ’। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল, শিল্পমহলের আস্থা অর্জন। বিশেষত যেখানে কিছু দিন আগে মোদী-সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন দীপক পরাখ, রাহুল বজাজের মতো পরিচিত মুখরা।

আস্থা ফিরল কি না, বলবে সময়। তবে তার জন্য মোদীর সামনে কাজ করার শর্তই রেখে এল শিল্পমহল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE