Advertisement
E-Paper

আরও বড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিতই দিল নেপাল, বলছেন বিজ্ঞানীরা

আফটারশক নয়। রবিবার দুপুরের কম্পনটি নতুন একটা ভূমিকম্প। ৬.৭ রিখটার-মাত্রার কম্পনটির উৎসও লেই নেপালে— কাঠমান্ডুর দেড়শো কিলোমিটার দূরে, কোদরায়। কাঠমান্ডুর ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে শনিবার যে ভূমিকম্পটি তৈরি হয়েছিল, তার জেরে রবিবার সকাল পর্যন্ত অন্তত তিরিশ বার কেঁপে উঠেছে নেপালের মাটি। ভূ-বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, সেগুলো সব আফটারশক। এর একটার মাত্রা ছিল ৬.১। তারই দৌলতে শনিবার দুপুরে প্রথম কম্পনের আধ ঘণ্টা পরে কলকাতাও ফের কেঁপে ওঠে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪০
সংখ্যাই এখন পরিচয়। কাঠমান্ডুর একটি হাসপাতালের বাইরে এ ভাবেই রাখা হয়েছে মৃতদেহ। ছবি: রয়টার্স।

সংখ্যাই এখন পরিচয়। কাঠমান্ডুর একটি হাসপাতালের বাইরে এ ভাবেই রাখা হয়েছে মৃতদেহ। ছবি: রয়টার্স।

আফটারশক নয়। রবিবার দুপুরের কম্পনটি নতুন একটা ভূমিকম্প। ৬.৭ রিখটার-মাত্রার কম্পনটির উৎসও লেই নেপালে— কাঠমান্ডুর দেড়শো কিলোমিটার দূরে, কোদরায়।

কাঠমান্ডুর ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে শনিবার যে ভূমিকম্পটি তৈরি হয়েছিল, তার জেরে রবিবার সকাল পর্যন্ত অন্তত তিরিশ বার কেঁপে উঠেছে নেপালের মাটি। ভূ-বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, সেগুলো সব আফটারশক। এর একটার মাত্রা ছিল ৬.১। তারই দৌলতে শনিবার দুপুরে প্রথম কম্পনের আধ ঘণ্টা পরে কলকাতাও ফের কেঁপে ওঠে।

রবিবার দুপুরের কম্পনের পরেও প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল, এ-ও আফটারশক। কিন্তু সঠিক অবস্থান, মাত্রা ও উৎসস্থল বিশ্লেষণ করে ভূ-বিজ্ঞানীদের মালুম হয়েছে, এটি একটি নতুন ভূমিকম্প। ঘটনা হল, কোথাও বড় মাপের ভূমিকম্প হয়ে গেলে কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে আর একটা বড়-সড় ভূকম্প প্রায় নজিরবিহীন। তা হলে এ দিন হল কী ভাবে?

আইআইটি খড়গপুরের ভূকম্প-বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথের ব্যাখ্যা, ‘‘শনিবার ভারতীয় প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সময় দু’জায়গায় ফাটল তৈরি হয়েছে। তবে শক্তি নির্গত হয় কাঠমান্ডুর কাছের ফাটল দিয়ে। চব্বিশ ঘণ্টা বাদে অন্য ফাটলটিও নিজের সঞ্চিত শক্তি উগরে দিয়েছে।’’

আর তাতেই নতুন ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে বলে শঙ্করবাবুর দাবি। ওঁর আরও যুক্তি: আফটারশকের মাত্রা সাধারণত দিন দিন কমতে থাকে। তা ছাড়া মূল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের দেড়শো কিলোমিটার দূরে হওয়া আফটারশকের মাত্রা কখনওই এতটা বেশি হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, এ দিনের ৬.৭ মাত্রার কম্পনের ওই একই জায়গায় কুড়ি মিনিটের ব্যবধানে দু’টি আফটারশকও ধরা পড়েছে সিসমোগ্রাফে। মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫ ও ৪.৭ রিখটার।

বস্তুত মূল ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটলেও কাঁপুনি যে আগামী ক’দিন নেপালের পিছু ছাড়বে না, ভূ-বিজ্ঞানীরা তা জানিয়ে দিয়েছেন। শনিবারের ভূমিকম্পের আফটারশকের পাশাপাশি এখন দ্বিতীয় ভূমিকম্পের আফটারশক শুরু হয়েছে। তার মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও আগামী সাত দিন রাত-বিরেতে ছোটখাটো কম্পনে নেপালবাসীর ঘুম উবে যেতে পারে।

আফটারশক হয় কী ভাবে?

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, একটা বড় ভূমিকম্পের প্রভাবে ভূগর্ভের বিভিন্ন প্লেট অস্থির হয়ে পড়ে। প্লেটে প্লেটে ঘর্ষণ বাড়ে, তাদের অবস্থান বদলায় ঘন ঘন। ফলে তামাম এলাকা বেশ কিছু দিন পর্যন্ত হামেশা কাঁপতে থাকে। বড় ভূমিকম্প-পরবর্তী এ হেন লাগাতার কম্পনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াই হল ভূমিকম্পোত্তর কম্পন বা আফটারশক।

উদাহরণ হিসেবে ২০০৪-এর সুনামির প্রসঙ্গ আসছে। ভূ-বিশারদেরা জানিয়েছেন, ওই বিপর্যয়ের এক মাস পর্যন্ত আন্দামানে ঘন ঘন আফটারশক হয়েছে। তবে সেগুলোর কম্পনমাত্রা রিখটার স্কেলে চার-পাঁচের বেশি ছিল না। কলকাতায় বসে টেরও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, নেপালের ক্ষেত্রে শুধু যে আফটারশকের তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে তা-ই নয়, ওই তল্লাটে অদূর ভবিষ্যতে ৯ রিখটারের অতি প্রবল ভূমিকম্পেরও প্রভূত সম্ভাবনা।

কেন?

শঙ্করবাবুর ব্যাখ্যা: হিমালয়ে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে যে তিনটি ‘খোঁচা’ রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান প্রান্তীয় (মেন বাউন্ডারি) খোঁচাটি সবচেয়ে অস্থির। শনিবারের ভূমিকম্প ঘটেছে সেখানেই, যার দরুণ সেটি আরও অস্থির হয়ে গিয়েছে। ফলে ওখানকার দু’টি প্লেটের মধ্যেকার ছোট ছোট চ্যুতিগুলিতেও শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করেছে। উপরন্তু আর কোথায় কোথায় ফাটল ধরেছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ‘‘ওই সব ফাটলে যত শক্তি সঞ্চিত হবে, তত বাড়বে ভূমিকম্পের আশঙ্কা।’’—হুঁশিয়ারি শঙ্করবাবুর।

হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্পপ্রবণ খাঁজ ও চ্যুতিগুলিকে ইতিমধ্যে শনাক্ত করেছেন আইআইটি খড়গপুরের ভূ-পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা। সেগুলোয় সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ শক্তি নেপাল, সিকিম, কাশ্মীর কিংবা অসম-অরুণাচলে অদূর ভবিষ্যতে একাধিক অতি প্রবল ভূমিকম্প ডেকে আনতে পারে বলে তাঁরাও মনে করছেন। ওঁদের আক্ষেপ: গোটা হিমালয় অঞ্চলের পরিস্থিতি দারুণ রকম নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ব্যাপক ভাবে জঙ্গল ধ্বংস আর ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বিধি ভেঙে যত্রতত্র বাড়ি-সেতু-হোটেল ইত্যাদি গজিয়ে ওঠায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

এমতাবস্থায় এখনও ওখানে তেমন বিপর্যয় ঘটেনি কেন, তা ভেবেই বিশেষজ্ঞেরা কিছুটা অবাক। শঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘নেপালে শনিবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত ছিল, তাতে ৯ মাত্রার কম্পন হতেই পারত। ২০১১-র সেপ্টেম্বরে সিকিমের যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেখানেও যে কোনও দিন ৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প তৈরি হতে পারে।’’

হিমালয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বড় ভূমিকম্পের যে তালিকা দিল্লির মৌসম ভবনে মজুত, তার শীর্ষে রয়েছে ১৯৫০ সালের অসমের ভূমিকম্প (মাত্রা ৮.৬ রিখটার)। দ্বিতীয়টি ১৯৩৪ সালে নেপাল-বিহারের (৮.১)। ২০০৫-এ কাশ্মীরের (৭.৬) ও ১৯০৫-এ হিমাচলে কাংড়ার (৭.৫) ভূকম্পেও বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ২০১১-র সিকিমের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৯। আর শনিবার নেপালে ৭.৯।

অর্থাৎ, হিমালয় অঞ্চলে এ পর্যন্ত ৯ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্পের কোনও রেকর্ড মৌসম ভবনে নেই। তা সত্যিই কখনও হলে কল্পনাতীত বিপর্যয় হতে পারে বলে হিমালয় সংলগ্ন সব রাজ্যকে বারবার সতর্ক করেছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা। কম্পননিরোধক প্রযুক্তিতে বাড়ি-ঘর, সেতু নির্মাণের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। ‘‘এই ঔদাসীন্যের মাসুল কী ভাবে দিতে হয়, শনিবারের নেপাল আবার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।’’— বলছেন এক বিশেষজ্ঞ।

Nepal earthquake disaster experts earthquake scientists Debdut Ghosh Thakur India Kathmandu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy