সেই পাইনের বন আজও আকাশের সঙ্গে ঝিরঝিরিয়ে কথা বলে। পাথরে ঝাঁপিয়ে বয়ে যায় লিডার নদী। পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপে। পহেলগামে সবই আগের মতো আছে। শুধুপ্রাণ নেই!
আর সব গ্রীষ্মে পর্যটকে ভরে ওঠে এখানকার হোটেল-রিসর্টগুলো। রাস্তা গমগম করে পরিযায়ী মানুষের কোলাহলে। দোকানে দোকানে ভিড়, ঘোড়াওয়ালাদের ব্যস্ততা, অজস্র গাড়ির ঘর্ঘরানি। আর এখন? কী অস্বস্তিকর রকম চুপচাপ এই পহেলগাম। এমনকি চায়ের দোকানও মাছি তাড়াচ্ছে। কাফে কিংবা শালের দোকানের বন্ধ শাটারে জমছে ধুলো। হাতে গোনা দু’চার জন পর্যটককে দেখা গেল। সকালে পহেলগামে এসে বিকেলেই ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা।
বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গি হামলার পরে দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। ২২ এপ্রিল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কয়েক জন বন্দুকধারী ২৬টা নিরীহ মানুষকে খুন করে চলে গিয়েছিল। সেই জঙ্গিরা কেউ ধরা পড়েনি আজও। কূটনীতির পারদ চড়েছে, পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটি ভারতীয় সেনা গুঁড়িয়ে দিতেই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে দুই দেশ। নিয়ন্ত্রণরেখায় পাক সেনার গোলায় প্রাণ গিয়েছে আরও কত সাধারণ মানুষের। বহু গ্রেফতারি আর জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব চলেছে। ব্যাপক তল্লাশি হয়েছে পহেলগাম লাগোয়া এলাকায়। ব্যবহার হয়েছে ড্রোন থেকে সন্ধানী কুকুর। কিন্তু বৈসরনের সেই জঙ্গিদের আর ধরা যায়নি।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, জঙ্গিরা পির পঞ্জাল পর্বতমালা থেকে মধ্য কাশ্মীর পর্যন্ত ছড়ানো গভীর জঙ্গলেই এখনও লুকিয়ে রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কড়া নজরদারি পেরিয়ে পাকিস্তানে হয়তো ফিরতে পারেনি পাক নাগরিক তালহা ও আসিফ ফৌজি এবং অনন্তনাগের আদিল হুসেন ঠোকর। বৈসরনের হামলাকারীদের মধ্যে এই তিন জনকেই চিহ্নিত করার পরে তাদের মুখের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ (এসওজি)-এর কর্তাদের সন্দেহ, সম্ভবত বৈসরনে হামলা চালানোর ঠিক পরেই পির পঞ্জালের কোনও খাঁজে সেঁধিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। অনন্তনাগের এক এসওজি অফিসার বলছিলেন, ‘‘এখানে লুকিয়ে থাকা সহজ। এই জঙ্গল দিয়ে কুলগাম, শোপিয়ান এমনকি সীমান্ত-ঘেঁষা পুঞ্চ বা রাজৌরিতেও পৌঁছে যাওয়া যায়। আমাদের বিশ্বাস, ওরা জঙ্গলেই গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের হয়তো রসদ জোগাচ্ছে জঙ্গিদের কোনও স্লিপার সেল বা প্রকাশ্য সংগঠনের লোকজন।’’
তল্লাশি অভিযানের দলে থাকা এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘বড়সড় হামলার পরে জঙ্গিদের এ ভাবে উধাও হয়ে যাওয়াটা এই প্রথম নয়। তারা জানে, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার জন্যই এখানে কোথাও কোথাও সেনার গতিবিধি সীমিত। তাই জঙ্গলের এই রুট জঙ্গিদেরও পছন্দের। অনেক সময়ে খাবারের উচ্ছিষ্ট, আগুন জ্বালানোর চিহ্ন কিংবা পায়ের ছাপ দেখে তল্লাশি চলে। কিন্তু এই জঙ্গিরা পাহাড়ি যুদ্ধেরই প্রশিক্ষণ নেওয়া।’’ জঙ্গিরা পুঞ্চ-রাজৌরি বা নিয়ন্ত্রণরেখার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে বলেই সন্দেহ করছেন পুলিশকর্তারা। সেই সঙ্গেই জানাচ্ছেন, বৈসরন বা অনন্তনাগ জেলার অন্য কোথাও হামলার কোনও আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। এসওজি-র এক অফিসার বললেন, বৈসরনের জঙ্গিরা আত্মঘাতী বাহিনীর সদস্য বলেই প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে। এর আগে রাজৌরির ভাট্টাদুরিয়ান, গুলমার্গ, গঙ্গানীর, গান্ডেরবালের মতো জায়গাতে হওয়া হামলায় এরাই জড়িত ছিল। বৈসরনে হামলা চালাতে তারা সময় নিয়েছিল বড়জোর ১৪ মিনিট।
আর সেই মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল পহেলগাম। এখানকার পাহাড়ি রাস্তার প্রতিটি বাঁকে এখন সশস্ত্র সেনা-পুলিশের চেকপয়েন্ট। সেখানে থামতে হচ্ছে সব গাড়িকেই। জঙ্গিদের ষড়যন্ত্রে স্থানীয়রা কারা জড়িত, তা বুঝতে টাট্টু ঘোড়াওয়ালা থেকে শুরু করে গাইডদের এখনও ডাকা হচ্ছে থানায় বা সেনা ছাউনিতে। আমির নামে এক ঘোড়াওয়ালা বলছিলেন, ‘‘এই নিয়ে এ মাসে ১২ বার এলাম হাজিরা দিতে। ওঁরা ভাবছেন, নিশ্চয়ই কিছু জানি। কী করে বোঝাই, আমরা তো বাজারে যেতেও ভয় পাচ্ছি।’’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো স্থানীয়দের লাইন পড়েছে পহেলগাম থানায়। পুলিশকর্তাদের দাবি, এঁদের অনেকেরই বাড়ির কোনও না কোনও ছেলে হয় সক্রিয় জঙ্গি, নয়তো সে পাকিস্তানে রয়েছে বলে খবর রয়েছে পুলিশের কাছে। এনআইএ-র একটি দলও এখানে ঘাঁটি গেড়েছে। এসওজি-র এক কর্তা আনন্দবাজারকে বলছিলেন, ‘‘কয়েকশো লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। জঙ্গিদের মরতে হবেই— কাল, নয়তো আগামী কোনও দিনে। ওরা যা করেছে, কোনও ধর্মই তাতে সায় দেয় না।’’
সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ বন্ধ হয়ে গেল সব দোকানপাট। আলোও চলে গেল। বাইরে একটাও লোক নেই। অন্ধকারে বসে মনে পড়ছে, স্থানীয়রা বলছিলেন, কত বিয়েবাড়ি, কত অনুষ্ঠান এই এক মাসে পিছিয়ে গিয়েছে বা কোনও মতে সারা হয়েছে। সামনেই অমরনাথ যাত্রা। কিন্তু পহেলগাম বুঝছে, এ বছরের মতো পর্যটনের গোটা মরসুমটাই বরবাদ হয়ে যেতে বসেছে। পর্যটনে ধাক্কা মানে রুজিতে টান। পহেলগাম টুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির মহম্মদ আকবর বলছিলেন, ‘‘নিরাপত্তার ভরসাটাকে চুরমার করে দিতে একটা মুহূর্তই যথেষ্ট। কিন্তু সেই ভরসা ফিরে আসতে বছর ঘুরে যেতে পারে।’’ এক দিকে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি। অন্য দিকে পহেলগামের দিনরাত্রি কাটছে ভয় আর অবিশ্বাসকে নিত্যসঙ্গী করে। নজরবন্দি হয়ে থাকার আতঙ্কে। এত ফিসফিসিয়ে আগে কথা বলত নাকি এই শহর?
পহেলগামের অদূরে লঙ্গনবালের গৃহবধূ ফতিমা জান বলেছিলেন, ‘‘এই শব্দহীন অবস্থাটা কোলাহলের চেয়েও বেশি অস্বস্তির।’’ আদৌ ভুল বলেননি। মানুষ নিভৃতে দু’দিন কাটাতে আসত পহেলগামে। আজ সেখানেই দম বন্ধ হয়ে আসছে অসহ্য স্তব্ধতায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)