আপাতদৃ্ষ্টিতে সামান্য পুরভোট। পরিষেবা সংক্রান্ত প্রশ্ন ছাপিয়ে সব রাজনৈতিক পক্ষের সামনেই পরীক্ষা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে ত্রিপুরা জুড়ে প্রশ্ন, আজ, বৃহস্পতিবার আগরতলা-সহ রাজ্যের ১৩টি পুর এলাকার ভোট কি শান্তিতে এবং সুষ্ঠু ভাবে হবে? প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হয়েছে প্রচার-পর্বে অশান্তি এবং হামলার জেরে।
ইতিমধ্যেই ৭টি পুর এলাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে রাজ্যের শাসক দল বিজেপি। তাদের দাবি, মানুষের সমর্থনেই অন্য পুর এলাকাগুলিও তাদের দখলে আসবে। সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস মিলে সব বিরোধী পক্ষ অবশ্য সমস্বরে উদ্বেগ জানাচ্ছে সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে।
বস্তুত, আগরতলা শহর বা বাইরের মফস্সলে ভোটের হাওয়া জরিপ করতে গেলে আম নাগরিকদের অনেকেই বলে দিচ্ছেন, ‘‘ভোট কেমন হয়, আগে দ্যাখেন!’’ ভোটের বাতাসে ভেসে বেড়ানো এই সংশয়কেই আরও স্পষ্ট করে বলছেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। গত লোকসভা ও পঞ্চায়েত ভোটের উদাহরণ দিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এখানে একদলীয় স্বৈরশাসন চলছে। সংবিধান মানা হয় না। নিজের ছায়াকেও নিজেরা বিশ্বাস করে না! তাই পুরভোটকে প্রহসনে পরিণত করতে চাইছে।’’ অধুনা বিরোধী দলনেতার কথায়, ‘‘মানুষকে এই সরকার বিশ্বাস করে না। মানুষেরও সরকারের উপরে আস্থা নেই।’’
প্রাক্তনের অভিযোগকে প্রত্যাশিত ভাবেই উড়িয়ে দিচ্ছেন বর্তমান। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের দাবি, ‘‘নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, সেই পথ ধরেই ত্রিপুরা শান্তি ও উন্নয়নের রাস্তায় এগিয়ে গিয়েছে। আগেকার অপশাসনের দিন আর নেই। বিরোধীরা নেতিবাচক প্রচার করলেও সাধারণ মানুষ শান্তি ও উন্নয়নের পক্ষে আছেন।’’ আর ভোটের ফল? মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ‘‘বিরোধীরা যা খুশি বলতেই পারেন। আমার মনে হয়, আগরতলায় আমরা ৫১টি ওয়ার্ডের ৫১টিই জিতব!’’
পুলিশ-প্রশাসনকে হাতে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লবই বিরোধী দমন করে পুর পরিষদ, নগর পঞ্চায়েত ও পুর নিগমে ক্ষমতা দখল করার ঘুঁটি সাজাচ্ছেন বলে অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের। দলের সাংসদ সুস্মিতা দেবের অভিযোগ, ‘‘ত্রিপুরায় গুন্ডাগিরি চলছে। নির্বাচন কমিশনের কোনও ভূমিকা নেই। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই প্রহসনে পরিণত করে দেওয়া হচ্ছে।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, আগরতলার মোট ৬৪৪টি পোলিং বুথকে দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। অতি স্পর্শকাতর প্রতি বুথে চার জন করে টিএসআর জওয়ান থাকবেন। স্পর্শকাতর বুথে চার জন করে সশস্ত্র পুলিশ।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী বা তৃণমূলের সুবল ভৌমিকদের পাল্টা প্রশ্ন, বুথে সশস্ত্র প্রহরা দিয়ে আর কতটা সুষ্ঠু ভোট করা যাবে? ভোটের আগেই দু’দিন ‘খেলা’ তো হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়! শাসক দলের বাহিনী এলাকায় গিয়ে গিয়ে মানুষকে ভোট দিতে বেরোতে নিষেধ করছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এমনকি, তাঁদের দাবি, বিজেপি সমর্থকদের বাড়িও বাদ যাচ্ছে না!
এমতাবস্থায় বিপ্লবের বিজেপির সামনে পরীক্ষা সুষ্ঠু ভোট করানো এবং শহরাঞ্চলে জনসমর্থনের বাক্স অটুট রেখে দেখানোর। সিপিএম, তৃণমূল-সহ বিরোধীদের উপরে লাগাতার হামলার জেরে ৪৪ মাসের শাসক পক্ষের গায়ে যে ‘ফ্যাসিস্ত’ তকমা পড়েছে, তা আরও এক বার যাচাই হয়ে যাবে পুরভোটেই।
বিরোধী সিপিএমের পরীক্ষা, ক্ষমতা হারানোর পরে মারের মুখে কুঁকড়ে গিয়ে হারিয়ে ফেলা জমি কিছুটা হলেও উদ্ধার করার। ওয়ার্ডের সংখ্যার চেয়েও ভোটপ্রাপ্তির শতাংশেই বেশি নজর তাদের। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্রের মন্তব্য, ‘‘জোর করে বিজেপি যদি নির্বাচনী ফায়দা তোলে, তাতে তাদেরই রাজনৈতিক ক্ষতি হবে।’’ একই অঙ্ক কংগ্রেসেরও। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিতে চালান হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের ভোট অনেকটা ফিরেছিল লোকসভায়। পুরভোটে একই লক্ষ্য তাদের।
অল্প সময়ে ময়দানে নেমে সব চেয়ে বেশি সংবাদমাধ্যমের নজর টেনেছে তৃণমূল। বাংলার শাসক দলের সামনে পরীক্ষা ত্র্রিপুরায় উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করে গিয়েছেন, মানুষ ভোট দিতে পারলে বিজেপি খাতাই খুলতেই পারবে না। তৃণমূলের তৎপরতা অবশ্য শুধু আগরতলা শহরেই।
বিজেপি নেত্রী ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক অবশ্য এ সব অঙ্ক উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ‘‘২৮ তারিখ ফলপ্রকাশ হলেই দুধ আর জল পরিষ্কার হয়ে যাবে!’’