—ফাইল চিত্র।
চপারের সঙ্গে সাইকেল, বাস এমনকী ভ্যানেও পাল্লা দেওয়া যায় না বলে রোদে পোড়া মুখগুলোয় সেদিন কি যে হতাশা! অসুস্থতার জন্য মে মাসের বিধানসভা ভোটের প্রচারে আম্মা চেন্নাইয়ের বাইরে জনসভা করেছিলেন কম। যেটুকু করেছিলেন তা-ও চপারে ঘুরে। তাই সব জনসভায় পৌঁছতে পারেননি এডিএমকে সমর্থকরা। কাঞ্চিপুরম থেকে মাইল দুয়েক দূরে ভারানভাসি গ্রামে সেদিন ওই যন্ত্রণা অবশ্য চাপা পড়ে গিয়েছিল কানের পর্দা ফাটানো চিৎকার আর ড্রামের আওয়াজে। আম্মার চপার দেখতে পেয়ে জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল। চার দিকে কেবল শোনা যাচ্ছিল, ‘‘ভারুগা! ভারুগা! আম্মা আম্মা আম্মা!’’ ভারুগা অর্থাৎ স্বাগত। জয়ললিতার জীবনের শেষ কয়েকটি রাজনৈতিক জনসভার একটিতে সেদিন এমনই আম্মা-উন্মাদনার সাক্ষী হয়েছিলাম।
সিল্কের শাড়ি আর মন্দিরবহুল ভারানভাসি গ্রামে গিয়ে দেখা গিয়েছিল এক বিরাট ফুটবল মাঠের পাশেই তৈরি হয়েছে অস্থায়ী হেলিপ্যাড। সেখানে ধুলো উড়িয়ে নেমেছিল জয়ললিতার চপার। নেমে একটু হেঁটে দ্বিস্তরীয় মঞ্চে উঠেছিলেন আম্মা। মঞ্চের নীচের স্তরে ছিল একটা বিস্তীর্ণ ডায়াস। তার চেয়ে ফুট দশেক উপরে এম জি রামচন্দ্রন আর আম্মার ছবিশোভিত মূল মঞ্চ। সেই উঁচু মঞ্চে উঠেছিলেন একা আম্মা। নেত্রীর পায়ের কাছে ডায়াসে তিন জেলার আঠারো জন বিধানসভা প্রার্থী সামনের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ঘণ্টা আগে থেকেই। নেত্রী বসার পরে বসেছিলেন তাঁরা।
আরও অগণিত তামিলনাড়ুবাসীর মতোই পেরিয়ার নগরের সিল্ক তাঁতি তানিম আনসারির রান্নাঘরেও নিশ্চয়ই আজ উনুন জ্বলেনি। ভারানবাসির প্রচারসভায় আম্মার বক্তৃতা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই তানিম চেঁচিয়ে গলার দফারফা করে ফেলেছিলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘‘আমি তো স্রেফ এসেছি ওঁকে দেখতে। উনি আমাদের মা। যা করেছেন ভোলার নয়। বন্যার সময় সব যন্ত্রপাতি প্রায় কুড়ি দিন ডুবে ছিল। উনি টাকা না দিলে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম?’’
আম্মার দলে তিনিই ছিলেন প্রথম এবং শেষ কথা। তামিলনাড়ুর নানা এলাকা ঘুরে শুনেছি, মানুষ জয়ললিতার পোস্টার দেখেই ভোট দেন। প্রার্থীর গুরুত্ব বিশেষ নেই। তাঁর জনসভায় মানুষের ঢল নামে। সভায় লাগামছাড়া উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য তাঁর মার্জিত কণ্ঠের বক্তৃতা যথেষ্ট অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। ভারানভাসিতে দেখেছিলাম, মূলত এক জায়গায় দাঁড়িয়েই বলছেন তিনি। শব্দপ্রয়োগ পরিশীলিত। শরীরের ভাষা শান্ত সমাহিত। অস্থিরতার কোনও লক্ষণ নেই। পনেরো মিনিটের মধ্যে বক্তৃতা শেষ। সেলুলয়েডের পর্দায় বহু নাচ-গান করেছেন এক কালে। কিন্তু মঞ্চে এককলি গান গাইতেও তাঁকে কোনও জনসভায় দেখেননি তাঁর ভক্ত সমর্থকরা। বক্তৃতার শেষে এক বারই মাত্র সরাসরি সামনের অগুন্তি কালো মাথার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে দেখা গিয়েছিল জয়ললিতাকে। ‘‘ডিএমকে ইস্তাহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে আমাদের সরকারের আমলে শুরু হওয়া সমস্ত প্রকল্প বন্ধ করে দেবে। আপনারা কি তাদের সেই সুযোগ দেবেন?’’ প্রশ্নটি পাতে পড়ার আগেই বজ্রনির্ঘোষে জবাব এসেছিল, ‘‘ইল্লে! ইল্লে!’’ অর্থাৎ ‘‘না, না।’’
বেঙ্গালুরু হাইওয়ের কাছ থেকে আড়াই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে ভারানভাসির সভায় এসেছিলেন সি বৈদ্যনাথন। একটি গাড়ি চালিয়ে দিন গুজরান করেন। আম্মা প্রসঙ্গে যাঁর বেশিটাই ব্যাখ্যাহীন আবেগ, যা যুক্তির ধার ধারছিল না। আর বাকিটা ‘আম্মা ওয়াটার’, ‘আম্মা ক্যান্টিন’, ‘আম্মা রোড’-এর সুফলের খতিয়ান। আম্মা শুধু জলই খাওয়াচ্ছেন না, অল্প দামে খাবার দিচ্ছেন, এমনকী সস্তায় সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা করছেন! বন্যায় শুধু ত্রাণই দিচ্ছেন না, রেশন কার্ড পিছু সরাসরি অর্থসাহায্য করছেন। ‘মায়ের মমতা’ কথাটা যে সেই তামিলনাড়ু সফরে কত বার শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই।
জনতার মধ্যে ‘আমি তোমাদেরই এক জন’ হিসেবে মিশে না গিয়েও মানুষের আনুগত্য ও অকুণ্ঠ সমর্থন সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন আম্মা। ভারানভাসির সভায় তিনি চলে যাওয়ার পরেও মানুষের দৃষ্টিতে বিহ্বলতা দেখেছিলাম দীর্ঘক্ষণ। কাল রাতের পর থেকে তৈরি হওয়া শোকের প্রবাহ হয়তো সময়ের সঙ্গে কিছুটা কমবে। কিন্তু হলফ করে বলা যায় এই আনুগত্য ও বিহ্বলতা তাঁর অনুগামীরা লালন করে যাবেন আমৃত্যু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy