Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সামনে ইন্দ্রাণী, তেরো ঘণ্টা জেরা পিটারকে

কর্তা-গিন্নি মুখোমুখি। ডাইনিং টেবিলে নয়, খার থানায় জেরার টেবিলে। শিনা বরা হত্যা মামলায় আজই প্রথম পিটার মুখোপাধ্যায়কে স্ত্রী ইন্দ্রাণীর সামনে বসিয়ে দিল মুম্বই পুলিশ। সঞ্জীব খন্না আর ইন্দ্রাণীর গাড়িচালক শ্যাম রাইও বাদ গেলেন না। যে পিটার ক’দিন আগেও টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, স্ত্রীকে তিনি ১০-এর মধ্যে ৯.৯ অবধি বিশ্বাস করেন, আজ সেই তিনিই জেরার মুখে স্ত্রীর সঙ্গে উত্তপ্ত বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন।

খার থানা থেকে বেরিয়ে আসছেন পিটার। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

খার থানা থেকে বেরিয়ে আসছেন পিটার। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

সুনন্দ ঘোষ
মুম্বই শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

কর্তা-গিন্নি মুখোমুখি। ডাইনিং টেবিলে নয়, খার থানায় জেরার টেবিলে।

শিনা বরা হত্যা মামলায় আজই প্রথম পিটার মুখোপাধ্যায়কে স্ত্রী ইন্দ্রাণীর সামনে বসিয়ে দিল মুম্বই পুলিশ। সঞ্জীব খন্না আর ইন্দ্রাণীর গাড়িচালক শ্যাম রাইও বাদ গেলেন না। যে পিটার ক’দিন আগেও টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, স্ত্রীকে তিনি ১০-এর মধ্যে ৯.৯ অবধি বিশ্বাস করেন, আজ সেই তিনিই জেরার মুখে স্ত্রীর সঙ্গে উত্তপ্ত বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন। খার থানার সামনে থিকথিকে ভিড়টার কাছে সেই খবরটুকু পৌঁছে যেতে দেরি হল না।

সেই সকাল দশটায় থানায় এসে ঢুকেছিলেন পিটার। ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে ন’টা ছুঁইছুঁই, বেরোলেন যখন রাত পৌনে এগারোটা বেজে গিয়েছে। এক দিকে মুম্বই পুলিশের ডিসিপি সত্যনারায়ণ চৌধুরী ও অন্য দিকে পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়ায় ডান হাত দীনেশ, ম্যারাথন জেরা করলেন প্রাক্তন টিভি ব্যারন পিটারকে। তাঁকে যে আজ ডাকা হতে পারে, সে ইঙ্গিত অবশ্য আগেই মিলেছিল। ২৮ তারিখ যখন পিটার নিজে থেকে চার পাতার লিখিত বয়ান জমা দিতে যান, পুলিশ তা নেয়নি। বরং বলেছিল, পরে ডেকে পাঠানো হবে। এর মধ্যে পিটারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফয়জল আহমেদকে জেরা করে পুলিশ। ওরলিতে ওই বন্ধুর কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই গাড়ি নিতেন পিটার। যে গাড়ির ভিতরে শিনাকে খুন করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, সে গাড়িটিও নাকি ফয়জলের কাছ থেকেই নেওয়া।

আজ সকালে সাদার উপরে ডোরা কাটা শার্ট আর ছাইরঙা ট্রাউজার পরা পিটার একাই প্রথমে আসেন। একটু পরে তাঁর ভাই গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। কেন? শোনা যাচ্ছে, পিটারের আর্থিক হিসেবপত্র অনেকটাই গৌতমের জানা। মুম্বই ও গোয়ায় ব্যবসা করেন গৌতম। দুই ভাইকে জেরা শুরু হওয়ার কিছু পরে ডেকে আনা হল গুঞ্জন মঙ্গলন নামে এক উকিলকেও। এই গুঞ্জন ছিলেন শিনার উকিল। তিনিও পিটার এবং শিনার আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে অনেক তথ্য জানেন।

অর্থাৎ? শিনা হত্যা মামলায় পিটার-ইন্দ্রাণী-শিনার মধ্যে টাকাকড়ির প্রশ্নটা তদন্তের আওতায় চলেই এল। তবে কি অর্থই সমস্ত অনর্থের মূল? সন্দেহটা গোড়ায় ছিলই। এখন কথাটা এখন অনেকেই জোরালো ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। জানা যাচ্ছে, নিজেদের সংস্থা আইএনএক্স মিডিয়া বেচে পিটার-ইন্দ্রাণী নাকি কয়েকশো কোটি টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা ইন্দ্রাণী, শিনা, গৌতম-সহ আরও অনেকের কাছে ভাগ করে রেখেছিলেন। যাঁরা টাকা রেখেছিলেন, তাঁরা সামান্য হলেও সেই টাকার ভাগও পেয়েছিলেন। পরে পিটার যখন টাকা ফেরত চান তখন সেই টাকা সকলে দিয়ে দেন। দেননি নাকি শুধু শিনা। এই যদি যুক্তি হয়, তা হলে কি শিনা খুনে পিটারেরও হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ? উত্তরে তারা শুধু জানাচ্ছে, এখনও কোনও সম্ভাবনাই বাদ দেওয়া হচ্ছে না। এ দিন পিটার যখন থানায়, তখন তাঁর ওরলির বাড়িতেও হানা দেয় পুলিশ। সেখান থেকে ল্যাপটপ, প্রিন্টার-সহ আরও কিছু জিনিস তুলে নিয়ে থানায় আসে তারা। পাশাপাশি মুম্বই পুলিশেরই আর একটি দল আবার কলকাতায় গিয়ে এ দিনই সঞ্জীবের ল্যাপটপ জোগাড় করেছে তাঁর বন্ধু অজয় রাওলার বাড়ি থেকে।


খার থানার বাইরে ভিড়। বুধবার। ছবি: সুনন্দ ঘোষ।

পিটারের জেরা চলাকালীনই বেলা ১২টা নাগাদ খার থানায় আনা হল ইন্দ্রাণীকে। এলেন সঞ্জীবও। ইন্দ্রাণীকে আগের দিন সান্তাক্রুজ এবং সঞ্জীবকে বান্দ্রা থানায় রাখা হয়েছিল। আর ধৃত চালক শ্যাম রাই খার থানাতেই ছিলেন। ৫ তারিখ পর্যন্ত এঁদের পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ। ইন্দ্রাণী গ্রেফতার হওয়া ইস্তক খার থানার সামনে রীতিমতো মেলা বসে গিয়েছে। মিডিয়া আর ওবি ভ্যানের ঠেলাঠেলিতে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়াই দায়। মুম্বইতে এখন শিনা মামলা ছাড়া কথা নেই কারও মুখে। সে কফিশপই আর এঁদো গলিই হোক। আজ সকালেই বিমানবন্দর থেকে হোটেলের পথে কুল-ক্যাবের চালক মহম্মদ মহসিন তো গোটা রাস্তা একের পর এক প্রশ্নে ঝাঁঝরা করে দিলেন। তাঁর মূল আগ্রহ একটাই, ‘‘বলুন তো, এত দিন বাদে আপনার শহরে (কলকাতা) এ লোকটা কোথা থেকে উদয় হল? বলছে, সে-ই নাকি শিনার বাবা! আর এর মধ্যে প্রাক্তন স্বামীই বা (সঞ্জীব খন্না) কী করে জড়িয়ে গেল?’’ একটি সূত্রের ধারণা, এমনও হতে পারে, ইন্দ্রাণী ও সঞ্জীবের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক দানা বাঁধছিল। সে কথা শিনা জানতে পেরে ব্ল্যাকমেল করছিলেন। সে কারণেই হয়তো তাঁকে সরে যেতে হল। যে ব্যক্তি প্রথম রাকেশ মারিয়াকে ফোন করে শিনা খুনের ‘টিপ-অফ’ দেন, তিনি কি এমন কোনও ইঙ্গিতও করেছিলেন? সেই ব্যক্তির খোঁজ চলছে। তিনি নাকি মেরঠে থাকেন।

রাকেশ মারিয়া সম্পর্কে এ শহরের ধারণাটা কিঞ্চিৎ অন্য রকম। একরোখা মানুষ। একটা কেস হাতে নিলে তার শেষ দেখেই নাকি ছাড়েন তিনি। সেই শেষ দেখার অপেক্ষাতেই টগবগ করে ফুটছে মুম্বই। আপাতত পুলিশের প্রধান কাজ, খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। বিকেল চারটে নাগাদ বেরিয়ে গিয়েছেন পিটারের ভাই গৌতম। কিন্তু পিটারের ছুটি তখন মেলেনি। মাঝে বেশ কিছু ক্ষণ তাঁর একার জেরা চলছিল। রাত আটটার পরে আবার তাঁকে ইন্দ্রাণীর মুখোমুখি বসানো হয় বলে শুনলাম। তার মধ্যে আবার পিটারের আইনজীবীর সঙ্গে পুলিশের এক প্রস্ত বচসাও হয়ে যায়। আইনজীবী এক বার বাইরে বেরোতেই ছেঁকে ধরেছিল মিডিয়া। তিনি বলে দেন, ‘‘একটা কথাও বলব না।’’ পুলিশের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়ালের অভিযোগও তোলেন। প্রায় তেরো ঘণ্টা পর পিটার যখন ছাড়া পেলেন, তখন তাঁর চোখমুখ ঝুলে গিয়েছে। অজস্র ক্যামেরা আর বুম ঘিরে ধরল তাঁকে। পিটারের মুখ থেকে কোনও কথা বেরোল না। একবার কী বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। শেষে দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন কেবল।

একটা কালো গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন পিটার। মুম্বইও এ দিনের মতো বাড়ির পথে পা বাড়াল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE