Advertisement
E-Paper

ওবামার দেশে ত্রিমুখী কৌশল প্রধানমন্ত্রীর

২০০০ সাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী নিউ ইয়র্ক শহরে অনাবাসী ভারতীয়দের এক সভায় নরেন্দ্র মোদীকে দেখে হঠাৎ বলে উঠেছিলেন, “আর কত দিন আমেরিকায় থাকবেন? নরেন ভাই, এ বার দেশে ফিরুন। সেখানে অনেক কাজ আছে।” নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তখন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের ভয়ঙ্কর বিরোধ। বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের বাইরে দলের কার্যকলাপ ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। এর পর হাডসন আর গঙ্গায় জল অনেক বয়ে গিয়েছে। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন এবং প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নিউ ইয়র্কে। ছবি: পিটিআই

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন এবং প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নিউ ইয়র্কে। ছবি: পিটিআই

২০০০ সাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী নিউ ইয়র্ক শহরে অনাবাসী ভারতীয়দের এক সভায় নরেন্দ্র মোদীকে দেখে হঠাৎ বলে উঠেছিলেন, “আর কত দিন আমেরিকায় থাকবেন? নরেন ভাই, এ বার দেশে ফিরুন। সেখানে অনেক কাজ আছে।”

নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তখন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের ভয়ঙ্কর বিরোধ। বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের বাইরে দলের কার্যকলাপ ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। এর পর হাডসন আর গঙ্গায় জল অনেক বয়ে গিয়েছে। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী।

২০০২ সালে এল গোধরা কাণ্ড ও গুজরাত দাঙ্গা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভাতেই বক্তৃতা দিতে গিয়ে গোধরা প্রসঙ্গ টেনে এনে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। মুশারফ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কাশ্মীরি মুসলমানদের বাজপেয়ী সরকার কী ভাবে নিরাপত্তা দেবে? গোধরার পরে আমেরিকাও ব্রাত্য করে গুজরাতি নেতা নরেন্দ্র মোদীকে। ভিসা বিতর্ক চলে বহু দিন। যে মোদী একদা নিউ ইয়র্ক শহরেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, তাঁর আমেরিকা সফরের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সেই প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর টপকে ‘শো-ম্যান’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই মুহূর্তে আবার সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্য বিল ক্লিন্টন নৈশভোজ দিয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে। আর এ বার বারাক ওবামা সেই সাদা বাড়িতেই ডাকলেন নরেন্দ্র মোদীকে। নিউ ইয়র্কে মার্কিন কংগ্রেসের বহু সদস্যের উপস্থিতিতে তাঁকে ঘিরে এক বিপুল উন্মাদনা দেখল পৃথিবীর মানুষ।

মোদীর সফরের পরবর্তী পর্ব ওয়াশিংটনে। সেখানে মার্কিন সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করবেন প্রধানমন্ত্রী। এই মুহূর্তে মূল্যবান প্রশ্নটি হল, এই সফর থেকে ভারত কী পেতে পারে? দিল্লির প্রত্যাশাই বা কী?

আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমার হাতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নেই। আমি জানি, মানুষের প্রত্যাশা গগনচুম্বী। কিন্তু কূটনীতিতে অনেক স্তর থাকে। আমার প্রধান কাজ দুই দেশের সম্পর্কের ভিতটাকে মজবুত করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। একটা গাছের চারায় জল দিলে গাছটা হতেও সময় লাগে। কিন্তু জল দেওয়ার কাজটিই তো মালি এত দিন সুষ্ঠু ভাবে করেননি।” প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় সূত্র বলছে, এ বার নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য তিনটি গোষ্ঠী। প্রথমত, প্রবাসী ভারতীয়রা। তাঁদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনরা রয়েছেন, আবার অনাবাসী ভারতীয় নাগরিকেরাও আছেন। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়টি খুবই ধনী ও শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী। মার্কিন নির্বাচনেও এঁদের প্রভাব অসীম। আবার ইজরায়েলের সঙ্গেও এই গোষ্ঠীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জে মোদী ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা চলার সময় কোনও ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এই প্রথম। এই বিষয়টিকে ভারতীয় কূটনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বড় পরিবর্তন মনে করা হচ্ছে। তৃতীয় লক্ষ্য, মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের বিশিষ্ট সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি।

আমেরিকার বহু কূটনীতিক অভিযোগ করেছেন, পরমাণু চুক্তির আগের পর্বে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের নেতৃত্বে একটি ‘প্রো-অ্যাকটিভ কূটনীতি’ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তার পরের দুই রাষ্ট্রদূত মীরাশঙ্কর ও নিরুপমা রাওয়ের সময়ে নানা কারণে আমেরিকায় ভারতীয় কূটনীতি শীতঘুমে চলে যায়। মোদী এখন বর্তমান রাষ্ট্রদূত জয়শঙ্করের নেতৃত্বে আবার এই সংযোগ স্থাপনে মরিয়া।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, বারাক ওবামা কী চাইছেন?

তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র বাকি দু’বছর। এক বছরের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। কূটনীতিকদের মতে, ওবামা এই সফরে ভারতের কাছ থেকে বিরাট কোনও প্রত্যাশা রাখছেন না। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য, কোনও ভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের কথা বলে ভারতকে হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য করা। এই নিষেধাজ্ঞার অর্থ, রেফ্রিজারেটরে এখন যে গ্যাস ব্যবহার করা হয়, তার পরিবর্তে নতুন গ্যাস ব্যবহার করা হবে। ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলির তাতে প্রবল আপত্তি। কারণ, এই পরিবর্তন করা মানে সামগ্রিক ভাবে গোটা প্রযুক্তির পরিবর্তন। তাতে বিরাট খরচ আছে। উপভোক্তাদের উপর তার চাপ এসে পড়বে। হরিয়ানার বেশ কিছু সংস্থা এই গ্যাস উৎপাদন করে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর সাংসদ পুত্র দীপেন্দ্র হুডা এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সরব হয়েছেন। ভারতীয় এক কূটনীতিকের কথায়, “দিল্লিতে বসে বোঝা যাবে না, ওবামার কাছে এটি কত বড় একটি বিষয়। গোটা বিশ্বে যদি তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, তা হলে পরিবেশ সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি হবেন বিশ্বনেতা। যেটি আমেরিকায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।” অতীতে ওজোন গ্যাস নির্ভর প্রযুক্তি, যেটিকে মন্ট্রিল-পদ্ধতি বলা হয়, তা বদলে হাইড্রোফ্লুরোকার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার শুরু হয়। এখন সেটিকে বদলে এইচএফও প্রযুক্তি আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে যতই বন্ধুত্ব করার প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদী দিন না কেন, এখনই এই বিষয়ে মার্কিন চাপের কাছে নতিস্বীকার করতেও তিনি রাজি নন। এই পরিবর্তন হলে মার্কিন সংস্থাগুলির ভারতীয় বাজারে বরাত পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি পরিবর্তনের জন্য আমেরিকার কাছ থেকে ভারত বিপুল অর্থ সাহায্য চাইতে পারে।

পরমাণু চুক্তি হওয়ার পরেও পদ্ধতিগত কারণে মার্কিন পরমাণু সংস্থাগুলির ভারতের বাজারে ঢোকা বাধা পেয়েছে। বরং ফ্রান্স, রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছে দিল্লি। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির সীমা আরও বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। আজ নিউ ইয়র্কের প্যালেস হোটেলে মোদীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে ১১ জন মার্কিন কর্পোরেট কর্তার। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পেপসিকো-র ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও ইন্দ্রা নুয়িও। মোদী তাঁদের জানান, কয়লাখনি বণ্টন বাতিল হওয়ার রায়কেও সুযোগ হিসেবে দেখছে তাঁর সরকার। এই সুযোগে অতীতের ভুল সংশোধন করতে চান তাঁরা।

সন্ত্রাসের প্রশ্নে আমেরিকাকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা সব সময়েই মোদীর পক্ষে জরুরি। সন্ত্রাস দমনে আমেরিকা-ইজরায়েল অক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে মোদী বদ্ধপরিকর। মোদীর সফরের পরে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরও আমেরিকা যাওয়ার কথা। জাপানে গিয়ে মোদী চিন সম্পর্কে যা-ই মন্তব্য করুন কেন, জাপান প্রস্তাবিত শান্তি রাষ্ট্রগোষ্ঠীর সদস্য হতে ভারত কিন্তু রাজি হয়নি। কারণ, ভারত মনে করে চিনের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করাটা এখন দিল্লির স্বার্থের পক্ষে অনুকূল নয়।

নরেন্দ্র মোদী বলেন, “ভারতের বিদেশনীতি ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। সেই স্বার্থের নিরিখে আমেরিকা, চিন ও জাপান- বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে।” মোদীর মতে, হয় শত্রু, নয় বন্ধু, এই সাবেকি কূটনীতির স্ফটিকের বাইরে এসে ভারতীয় বিদেশনীতিকে দেখার সময় এসেছে।

অনাবাসীদের সাহায্যে বদ্ধ সভাগৃহ থেকে বেরিয়ে এসে উন্মুক্ত ম্যাডিসন স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে ভারতীয় কূটনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চান নরেন্দ্র মোদী।

modis visit to america Narendra Modi jayant ghosal obama strategy national news online national news india america
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy