E-Paper

ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয় না নাগা গ্রামসমাজ

ধর্ষণকে লালন করে না এই সমাজ। ধর্ষণ হলে তা অস্বীকারেরও প্রয়াস নেই। নাগাল্যান্ডে নারী-নিগ্রহ প্রতিরোধের মন্ত্র খুঁজলেন।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৫ ০৭:১৭
কোহিমার ওয়ান স্টপ সেন্টার।

কোহিমার ওয়ান স্টপ সেন্টার। —নিজস্ব চিত্র।

বৃষ্টি আর ধসে বিপর্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে কোহিমা থেকে কিগুয়েমা পৌঁছতে দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। গ্রামের চাতালকে পিছনে রেখে শ্যাওলা ধরা সরু সিঁড়ির রাস্তা গিয়ে মিশল পাহাড়ের কিনারের একটি ছোট্ট বাড়িতে। এক যুবতী বাইরের ঘরে বয়নের কাজে ব্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল কোতোকু সাতো এ গ্রামে ঘাঁটি গাড়ার পরে এখানে থাকতেন। বাড়িটা গ্রামবাসীরা আজও যত্ন করে রেখেছেন, কারণ সাতোকে তাঁরা পছন্দ করেছিলেন। গ্রামের প্রবীণেরা বলেন, পছন্দ করার অন্যতম কারণ, সাতো গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি।

১৯৪৪ সালের নাগা গ্রামসমাজের এই মনোভঙ্গিটি ২০২৫ সালেও অনেকটা অক্ষুণ্ণ বলে মনে হয়।

এ বছরের ৩১ মে নাগাল্যান্ডের পেরেন জেলার এক গ্রামের সত্তর বছরের এক ব্যক্তি চোদ্দো বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। তাকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি গ্রাম পরিষদ দ্রুত বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী তিন বছরের জন্য ওই ব্যক্তি আর গ্রামে ঢুকতে পারবে না। প্রথাসিদ্ধ আইন মেনে স্থির হয়— ওই ব্যক্তি গ্রামে ঢুকতে পারবে না, গ্রামের পুরনো সীমানার মধ্যেই থাকতে পারবে না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে পারবে না। গোটা গ্রাম নির্যাতিতা এবং তার পরিবারের পাশে থাকবে।

এই ঘটনাকে অনেকাংশে নাগাল্যান্ডের সমাজদর্পণ বলে গণ্য করা যায়। ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটা রেওয়াজ এখানে আছে। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে নাগাল্যান্ডে ধর্ষণের সংখ্যা যে সবচেয়ে কম, তার অন্যতম কারণ হয়তো বা এই। এনসিআরবি এখনও অবধি ২০২২ সালে শেষ যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে নাগাল্যান্ডে নথিভুক্ত ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ৭। ২০২০-তে এই সংখ্যাটা ছিল ৪, ২০১৯-এ ৮। সার্বিক ভাবে মহিলাদের প্রতি অপরাধের সংখ্যাও যদি ধরা যায়, নাগাল্যান্ডের রেকর্ড ঈর্ষণীয়।

পাহাড়ি রাজ্য। আয়তন কম, জনসংখ্যা কম, জনঘনত্ব কম। নাগাল্যান্ডে জাতি-সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে মানব পাচার এবং মাদক পাচারও খুব বড় সমস্যা। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে চুরি, খুনখারাপির প্রকোপ কম। একই ভাবে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহের প্রবণতাও কম। অসম ছাড়া উত্তর-পূর্বের বাকি রাজ্য এবং সিকিমের অবস্থাও ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলের থেকে ভাল। কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে একে? কোহিমার পুলিশ সদর দফতরে বসে প্রশ্নটা করা গেল। এডিজি পদাধিকারী পুলিশ কর্তা বললেন, জনজাতি সমাজের গড়নই এর জন্য দায়ী। মেয়েদের সুরক্ষা তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। জনজাতি সমাজের নিজস্ব কড়াকড়ি এবং নৈতিকতার বোধ আছে। পরিবারে মেয়েদের আদর আছে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তর পূর্বের মেয়েদের অংশগ্রহণও অনেক দিনের। ফলে নারী-পুরুষের সম্পর্কে সহজতা এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।

জনজাতি সমাজের এই নিজস্বতা বজায় রাখা অনেক দূর পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ অধিকারের কারণে। অনুচ্ছেদ ৩৭০ রদ হওয়ায় কাশ্মীর তার বিশেষ বন্দোবস্ত খুইয়েছে। ৩৭১ অনুচ্ছেদের ক ধারা অনুযায়ী নাগাল্যান্ড যে বিশেষ বন্দোবস্ত পায়, তা এখনও বহাল। যেমন বহাল ৩৭১ অনুচ্ছেদ বর্ণিত অন্যান্য রাজ্যের বিশেষ বন্দোবস্তও। ৩৭১-এর ক ধারা অনুযায়ী, নাগাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় রীতিনীতিতে সংসদীয় অনুশাসন চলে না। সামাজিক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে— জমি হস্তান্তর-সম্পত্তির অধিকার-বিবাহ-বিবাদ নিষ্পত্তি-স্থানীয় প্রশাসন-সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে জনজাতির নিজস্ব প্রথাগত অবিধিবদ্ধ আইনই প্রযোজ্য। সমতলের দিকে এই জনজাতি সমাজের বাঁধন অনেকটা আলগা, তাই সেখানে অপরাধের হারও বেশি। পুলিশ সূত্রেই জানা গেল, সারা বছরে নাগাল্যান্ডে যত অপরাধ হয়, তার বড় অংশই হয় ডিমাপুরে।

পেরেন জেলার ওই গ্রামের দৃষ্টান্তই নেওয়া যাক ফের। কিশোরীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনাটা ঘটেছিল গ্রামে নয়, ডিমাপুরের একটি হোটেলে। এই ডিমাপুরেই ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ধর্ষণের অভিযোগে ধৃত এক ব্যক্তিকে হাজার হাজার জনতা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে টেনে বের করে এনে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটিয়ে মারতে মারতে হত্যা করে এবং দেহটা ক্লক টাওয়ার থেকে ঝুলিয়ে রাখে। দৃশ্যতই সামাজিক প্রতিরোধ এটা নয়, সমতলের শহরে উন্মত্ত জনতাতন্ত্র।

তাই বলে প্রথাভিত্তিক আইনে মোড়া জনজাতি সমাজ কি পিতৃতন্ত্রের বাইরে? উত্তর খুঁজতে যেতে হল সেক্রেটারিয়েট রোড, কোহিমার মূল শহর থেকে একটু দূরে। ঘন সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এক-একটি সরকারি ভবন। অফিসপাড়া বলতে যে ছবিটা সাধারণ ভাবে চোখে ভাসে, তার চেয়ে একেবারে আলাদা। কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের অধীন মিশন শক্তি প্রকল্পের কার্যালয়ে বসে কথা বলছেন মিশন কোঅর্ডিনেটর গ্রেসি শু। বললেন, ‘‘পিতৃতন্ত্রের বাইরে কেউই নয়। নাগা পরিবারে কি মেয়েরা সব সময় নিরাপদ? গার্হস্থ্য হিংসার এত অভিযোগ তা হলে আমাদের হেল্পলাইনে আসছে কোথা থেকে? নাগাল্যান্ডের রাজনীতিতে মেয়েদের প্রবেশ এত দেরিতে হল কেন?’’ মনে পড়ল, নাগাল্যান্ড তার প্রথম মহিলা বিধায়ক হেকানি জাখালু এবং সালহুতুনুয়ো ক্রুসে-কে পেয়েছে এই সবে, ২০২৩ সালে। তবু গ্রেসিই উল্লেখ করলেন, মেয়েদের কথা বলার জায়গাটাও কিন্তু জনজাতি সমাজের মধ্যে আছে। নাগাল্যান্ডে প্রায় ১৭টি জনজাতির বাস। অঙ্গামি জনজাতি তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। গ্রেসি নিজে সুমি জনজাতির মেয়ে। বললেন, ‘‘প্রত্যেকটি জনজাতির নিজস্ব মহিলা সংগঠন আছে। নাগা ভাষায় যার নাম টোটিমি হোহো। মেয়েদের উপরে নির্যাতন হলে টোটিমি হোহো চুপ করে থাকে না। গ্রাম প্রশাসনই হোক বা রাজ্য প্রশাসন, সকলেই তাদের কথাকে গুরুত্ব দেয়।’’ নাগাল্যান্ডে শান্তি প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়া ‘নাগা মাদার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এই টোটিমি হোহো-দেরই এক ছাতার তলায় এনেছিল।

বিশেষত্ব এই যে, অন্যান্য রাজ্য যখন অপরাধের বাড়বৃদ্ধিকে নথিভুক্তির সাফল্য মনে করে সন্তুষ্ট হতে চাইছে, নাগাল্যান্ড হাঁটছে উল্টো দিকে। প্রশাসন নিজেই পরিসংখ্যান দেখে ভুরু কুঁচকিয়ে ভাবছে, সব অপরাধ নথিভুক্ত হচ্ছে তো আদৌ? গত নভেম্বরে নাগাল্যান্ড মহিলা কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কোহিমার এডিসি এবং মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিজেরাই বলেন, পরিসংখ্যানে সবটা ধরা পড়ছে না। আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। মহিলা আইএএস অফিসারের হেনস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকার হেনস্থার মতো ঘটনা দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। ২০২৪-এর এপ্রিল থেকে ২০২৫-এর মার্চ পর্যন্ত মিশন শক্তির ওয়ান স্টপ সেন্টারে ১১টি ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছে। মিশন শক্তির আধিকারিকদের কাছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্য গার্হস্থ্য হিংসা। কারণ তাঁদের মতে— অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ নথিভুক্ত হচ্ছে না, জনজাতি আইনের বিবাদ নিষ্পত্তির চৌকাঠে আটকে যাচ্ছে।

কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন-পথচলতি মানুষ সকলেই একটা দাবি জোর গলায় করছেন, ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটলে তা চাপা দেওয়ার অভ্যাস নাগাল্যান্ডের নেই। যে নাগা পাহাড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম রডোডেনড্রন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পারতপক্ষে ধর্ষণের প্রশ্রয় নেই। অন্তত এখনও।

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

nagaland Women Harassment Rape

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy