Advertisement
E-Paper

সৃষ্টির হাতে স্রষ্টার ‘মৃত্যু’! ভোটের সফল ‘ঠিকাদার’ ব্যর্থ দল গড়ে, ঘরের মাঠ বিহারে ফিকে ভোটকুশলী পিকে

মোদীকে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী করার ভোটের প্রচারের সময়ে পিকে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা হুবহু মিলে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ভোটে তৃণমূলের ক্ষেত্রে যা বলেছিলেন, তা-ও অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়েছিলেন তিনি। সে ছিল ভোটকুশলী পিকে-র ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু নেতা পিকে ডাহা ব্যর্থ হলেন।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ২০:১০
নেতা হিসাবে ব্যর্থ হলেন সফর ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর।

নেতা হিসাবে ব্যর্থ হলেন সফর ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। — ফাইল চিত্র।

তাঁর ‘সৃষ্টি’ ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী নিরাপদে পার করিয়ে দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চার বছর পর সেই সৃষ্টির কাছেই রাজনৈতিক ‘মৃত্যু’ হল স্রষ্টার। সৃষ্টির নাম ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। স্রষ্টার নাম প্রশান্ত কিশোর।

বিহারের ভোটে নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে স্থিতাবস্থা বিরোধিতাকে ধুয়েমুছে দিয়েছে যে প্রকল্প, তার নাম ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’। যে প্রকল্পে প্রথম দফার ভোটের ঠিক আগে ১ কোটি ২১ লক্ষ মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার করে টাকা নগদ ঢুকেছিল। যাকে ‘বিহারের লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বলা হচ্ছে। যে ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’-এর প্রাথমিক পরিকল্পনা মমতার জন্য গুছিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর (পিকে)।

কিন্তু বিহারের ভোটে পিকে-র শূন্য হাত প্রমাণ করে দিল, যাঁরা পরিকল্পনাকারী হিসাবে সফল, তাঁরা সেই পরিকল্পনার রূপকার হিসাবে ব্যর্থ হন। ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু সে কতিপয় ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে। ভোটকুশলীর কাজ ছেড়ে, নতুন দল গড়ে নেতা হতে চাওয়া পিকে তাই ভোটের ময়দান থেকে খালি হাতে ফেরেন। এর বদলে মহাগঠবন্ধনের ভোটকৌশল নির্ণয় করতে হলে তেজস্বী যাদবদের পরিস্থিতি হয়তো এত করুণ হত না।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন পিকে। তার পর বিভিন্ন দলের হয়ে তিনি কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮টি আসন জিতে ‘ধাক্কা’ দিয়েছিল তৃণমূলকে। তার পরেই ভোটের ‘ঠিকাদার’ পিকে-কে পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ করেছিল তৃণমূল। মমতার দল ফল পেয়েছিল। কিন্তু কুশলী কিশোর বিহারের রাজনীতিতে শিশু হয়েও আবির্ভূত হতে পারলেন না। ভ্রূণাবস্থাতেই এই নির্বাচন শেষ করতে হল তাঁর দল জনসুরাজ পার্টিকে।

মোদীকে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী করার ভোটের প্রচারের সময়ে পিকে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা হুবহু মিলে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ভোটে তৃণমূলের ক্ষেত্রে যা বলেছিলেন, তা-ও অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বিজেপি থেমে যাবে ১০০-র নীচে। আর তৃণমূলের আসনসংখ্যা হবে ২০০-র বেশি। তা-ই হয়েছিল। সে ছিল ‘ভোটকুশলী’ পিকে-র ভবিষ্যদ্বাণী। কিন্তু ‘নেতা’ পিকে বিহার ভোটের আগে একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল থেমে যাবে ২৫-এর কম আসনে। এ-ও বলেছিলেন, ‘‘জে়ডিইউ যদি যদি ২৫-এর বেশি আসন পায় আমায় বলবেন। তাতে জনসুরাজ পার্টি জিতলেও আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব।’’ জেডিইউ তার থেকে তিন গুণের বেশি আসনে জিতেছে। পিকে শূন্য!

যে পিকে ভোটকুশলী হিসাবে নগদ দেওয়ার রাজনীতি, জাতপাত, ধর্ম-বর্ণের অঙ্ক কষে রণকৌশল সাজাতেন, সেই তিনিই নেতা হয়ে হাঁটতে গিয়েছিলেন ভিন্নপথে। গান্ধীর দর্শনে গোটা বিহারজুড়ে যাত্রা করা, বামঘেঁষা প্রচারের ধাঁচে নিজেকে ভিন্ন গোত্রের রাজনীতিক হিসাবে তুলে ধরতে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রচারে বেশি বেশি করে উঠে আসছিল বিহারের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ। কেন তাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে থাকেন? কেন রাজ্যে কাজ নেই? কেন জাত-ধর্মের বৈষম্য? তুলে ধরেছিলেন বিহার এবং বিহারীর মর্যাদার প্রশ্নও। যেমন পিকের পরামর্শে ২০২১ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এ রাজ্যে তৃণমূল হাঁটছে বাংলা এবং বাঙালির গরিমার লাইনে।

কিন্তু পিকে শুধু প্রশ্নই তুলেছেন। বিকল্প কোনও মডেল বিহারবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেননি। পিকে-র প্রচারে নতুন প্রজন্মের বিপুল ভিড় হচ্ছে বলে অনেকে দাবি করেছিলেন। ভোটের ফল সেসব দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। ভোটারেরা দেখিয়েছেন, শেষকথা তাঁরাই বলেন। ভোটের তথাকথিত পণ্ডিতেরা নন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে পিকে-র সঙ্গে কাজ করা এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘উনি একটি কাঠামোর উপর কিছু রঙের পোঁচ লাগিয়েছিলেন। বিজেপির একটি সাংগঠনিক কাঠামো ছিল। ইউপিএ-২ জমানায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগও ছিল। সেই কাঠামোর উপর তিনি কিছু কারুকার্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে দল গড়ে নেমেছিলেন, তার কোনও কাঠামোই ছিল না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘হঠাৎ তৈরি হওয়া খুব কম দল প্রথম নির্বাচনে সাফল্য পায়। পেতে গেলে তাদের কিছু চমক দিতে হয়। যেমন অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি করেছিল। পিকে তা-ও করতে পারেননি।’’ পাশাপাশিই তৃণমূলের এক প্রবীণ সাংসদের বক্তব্য, ‘‘পিকে যখন আমাদের পরামর্শদাতা, তখন সাজানো সংগঠনের পাশাপাশিই সরকারেও আমরা। সব ছিল। কিন্তু অগোছালো। তিনি শুধু সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটে লড়ার জন্য সংগঠন লাগে। সেটা হঠাৎ করে হয় না।’’

শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন পিকে-র দলকে রেখেছে ‘অন্যান্য’দের বন্ধনীতে। ফলে জনসুরাজ পার্টি কত শতাংশ ভোট পেয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আসনওয়াড়ি ভোটের পুঙ্খানুপুঙ্খ ফলাফল স্পষ্ট হলে বোঝা যাবে পিকে কার ভোট কাটলেন। তবে প্রাথমিক ভাবে এনডিএ এবং মহাগঠবন্ধনের ভোট শতাংশের ফারাক স্পষ্ট করে দিচ্ছে, সে ভাবে ‘ভোটকাটুয়া’ও হতে পারেনি তাঁর দল। শুধু শূন্য হাতে ফেরা নয়। জনতার রায়ে জামানতটুকুও রইল না জনসুরাজের।

সব ভাল ছাত্র ভাল শিক্ষক হন না। বিহারের ভোট দেখাল, সফল ভোটকুশলীও সফল নেতা হন না।

Prashant Kishor TMC Bihar RJD
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy