হিসেব বহির্ভূত সম্পত্তি মামলায় তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে ১০০ কোটি টাকা জরিমানা করেছিল বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত। আজ সেই রায়ই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট।
আজ যে ৬৬.৬৫ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় শশিকলা ও তাঁর দুই আত্মীয়কে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত, সেই মামলার আসল অভিযুক্ত ছিলেন জয়ললিতাই। বাকি তিন জনের মতো তাঁকেও চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত। সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা জরিমানা। আজ সেই রায়ই বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। ৫০০ পৃষ্ঠার রায়ে উঠে এসেছে, জয়া কী ভাবে হিসাব-বহির্ভূত সম্পত্তি জড়ো করেছিলেন। শশিকলা ও অন্যেরা ছিলেন স্রেফ দাবার ঘুঁটি। নিজের বেআইনি সম্পত্তি শশিকলা, শশীর আত্মীয় ও তাঁদের মালিকানাধীন সংস্থার নামে লিখে দিয়েছিলেন জয়া। যাতে নিজের গায়ে দুর্নীতির দাগ না-লাগে। শশিকলারা সেই কাজে মদত দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু আইনের চোখে এই মামলার মূল ষড়যন্ত্রী আম্মা জয়ললিতাই!
এখন কী হবে?
আইনজীবীদের মতে, জয়ললিতার জন্য ধার্য ১০০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হবে। বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় সংস্থার নামে যে-সব সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলো অধিগ্রহণ করা হবে। জরিমানা উসুল করা হবে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে। বাজেয়াপ্ত করা হবে তাঁর সোনা আর হিরের গয়নাও।
সাধারণ ভাবে গয়নাগাঁটিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবেই ধরা হয়। কিন্তু জয়ার ক্ষেত্রে আদালত মনে করেছে, তাঁর বিশাল মূল্যের অলঙ্কারের পিছনেও রয়েছে দুর্নীতি। ২০১৬-র মে মাসে, বিধানসভা নির্বাচনের আগে হলফনামায় জয়ললিতা জানিয়েছিলেন, তাঁর অলঙ্কারের মূল্যই ৪১.৬৩ কোটি টাকা। তা ছাড়া তাঁর নামে বেশ কয়েকটি সংস্থা, প্রচুর আবাদি জমি ও সাতটি গাড়ি রয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দাম ১১৩.৭৩ কোটি টাকা, জানিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী।
শশিকলা আর জয়া। ফাইল চিত্র।
তামিলনাড়ুর প্রবীণ আইনজীবী ভি কন্নাদাসনের মতে, জয়ললিতার এই বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই জরিমানার ১০০ কোটি টাকা আদায় করা হবে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দেওয়া হবে না। যেমন, পোয়েজ গার্ডেনের বাড়ি, যা জয়া পেয়েছিলেন তাঁর মা এন আর সন্ধ্যার কাছ থেকে। পারিবারিক সূত্রে কিছু টাকা, গয়নাও পেয়েছিলেন জয়া। বাজেয়াপ্ত করা হবে না সেগুলোও। জয়ার স্বামী-সন্তান নেই। তাই হিন্দু উত্তরাধিকার আইন মেনে তাঁর ভাই, বোন বা তাঁদের ছেলেমেয়ে ওই ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’র মালিকানা দাবি করতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আজ পনীরসেলভমের বাড়ির সামনে থেকে শুরু করে সারা চেন্নাইয়ে উৎসব শুরু হলেও অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করছে। কারণ পনীরসেলভম শশিকলার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও জয়ললিতার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। উল্টে তাঁর দাবি, তিনিই প্রয়াত আম্মার প্রকৃত রাজনৈতিক উত্তরসূরি। অথচ আম্মার ছবিতেই এখন কালির ছিটে। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে আজ উৎসবটা কীসের!
আরও পড়ুন।
আম্মা-পনীরের পরে চিন্নাম্মারও ভরসা তিনি
অস্বস্তিতে পড়ে পনীরসেলভমের শিবিরের নেতারা বলছেন, সব দোষ শশিকলার। শশী চেয়েছিলেন তাঁর বোনপো ভি এন সুধাকরনের বিয়ে ধুমধাম করে হোক। সেই বিয়ের খরচ দেখেই প্রশ্ন ওঠে, এত টাকা কোথা থেকে এল? তাতেই গন্ডগোলের শুরু। পনীর-শিবিরের যুক্তি, আম্মা ছিলেন নিষ্পাপ। শশিকলাই তাঁকে দিয়ে বেআইনি কাজ করিয়েছেন।
আদালতের রায় কিন্তু তা বলছে না। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে রায় বলছে, ১৯৯১ থেকে ’৯৬— মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জয়ার প্রথম শাসনকালে তিনি ও শশিকলা এক গুচ্ছ ভুঁইফোঁড় কোম্পানি তৈরি করেন। এক দিনে ১০টি সংস্থা গড়ার প্রমাণও মিলেছে। শশিকলা ও সুধাকরনের নামে সম্পত্তি কেনা ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না ওই সংস্থাগুলোর। ওই সব সংস্থা চলত জয়ললিতার বাড়ি থেকেই। কাজেই জয়ললিতা জানতেন না বা তিনি নিষ্পাপ, সেই দাবি টিকছে না।
শশিকলা এবং বাকি দু’জন জয়ললিতার সঙ্গেই থাকতেন। রক্তের সম্পর্ক না-থাকলেও। আদালতের মতে, জয়ললিতা মানবিক কারণে তাঁর বাড়িতে শশিকলাদের আশ্রয় দেননি। আসলে নিজের বেআইনি সম্পত্তির ব্যবস্থা করতেই এক বাড়িতে বসে ষড়যন্ত্র করতেন তাঁরা। জয়া নিজেই আয়কর দফতরকে বলেছেন, তিনি শশী এন্টারপ্রাইজকে এক কোটি টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কাজেই তিনি শশীর ব্যবসায় যুক্ত নন, সেই দাবি করতে পারেন না। জয়ললিতা তাঁর জয়া প্রকাশনার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি লিখে দেন শশীর নামে। যাতে জয়ললিতা প্রকাশনার বেআইনি কাজ-কারবারের আঁচ তাঁর গায়ে না-লাগে।
জয়ার সঙ্গে বাকি তিন জনের ‘অবিচ্ছেদ্য যোগ’-এর সমস্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। যে-ভাবে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে শশিকলাদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকার আদানপ্রদান হয়েছে, তাতে প্রমাণিত, পুরোটাই জয়ললিতার জানা ছিল।
সব রায় নিয়েই বিতর্ক হয়। এই রায় নিয়েও অনেকের মত, নিম্ন আদালতের থেকেও কড়া শাস্তির বিধান দেওয়া উচিত ছিল সুপ্রিম কোর্টের। তা না-করে কার্যত নিম্ন আদালতের রায়ই তুলে ধরেছে শীর্ষ আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, কারাবাসের মেয়াদ না-বাড়লেও সরকার যে-ভাবে জয়ার জন্য ধার্য ১০০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করবে, ঠিক সেই ভাবেই শশীদের তিন জনের জন্য ধার্য ৩০ কোটি টাকা জরিমানাও আদায় করা হবে। হাত পড়বে তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গয়নাতেও।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিকেরা বলছেন, প্রয়াত জয়ললিতা এর আগেও দুর্নীতির বেশ কিছু মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আবার বেরিয়েও আসেন। নিজের ক্যারিশমা ও জনদরদি নীতিতে সেই দুর্নীতির কালিমা বেমালুম ধুয়ে ফেলেন। ‘আম্মা’ হয়ে উঠে আসেন জনমানসে।
এ বার আর সেই ভাবমূর্তি উদ্ধারের সুযোগ পেলেন না তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy