গোটা মোকামা শহর থমথমে। ভোটের প্রচার প্রায় বন্ধ। পটনা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে মোকামা পৌঁছনোর আগে সড়কের দু’দিকে মোকামা টাল এলাকা। গঙ্গার সমান্তরাল এলাকায় নিচু জলাভূমি। মোকামার মাফিয়া, ডন, বাহুবলীদের বিচরণক্ষেত্র।
দু’দশক আগে মোকামা টালের বাতাসে শুধুই বারুদের গন্ধ। আর জলায় খুন হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ভাসত বলে জনশ্রুতি। শুক্রবার মোকামার রাস্তায় পুলিশের তল্লাশি চলছে। বার বার একটা শব্দই কানেবাজছে। ‘মার্ডার’!
মোকামা স্টেশন রোডে গুরদেব টোলায় মহাকালী মন্দিরের সামনে গাড়ি থামাতে হল। মন্দিরের উল্টো দিকে জেডিইউ-এর নির্বাচনী ক্যাম্প। নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমারের ছবি রয়েছে। তবে নজর কেড়ে নেবে তাঁর ছবি। পেটানো চেহারা। চোখে বাহারি রোদচশমা। পাকানো গোঁফ। কপালে লাল টিকা। দেখে একটাই শব্দ মনে আসে। ‘বাহুবলী’।অনন্ত সিংহ। মোকামার ‘ছোটে সরকার’। ভূমিহার নেতা। চার বারের বিধায়ক। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে মোকামায় জেডিইউ প্রার্থী। সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি। আস্তাবলে ঘোড়া। গ্যারাজে আধ ডজন বিলাসবহুল এসইউভি। পুলিশের খাতায় ৩৮টি মামলা। চারটে অপহরণ। ১১টা খুনের চেষ্টা। সাতখানা খুনের। বাকিগুলো তোলাবাজি, বেআইনি অস্ত্র রাখার। এর মধ্যে পৈতৃক ভিটেতে একে-৪৭, গুলি, গ্রেনেড রাখার মামলায় বছর দুয়েক জেল খেটে গত বছর বেরিয়েছেন।
আজ আরও একটি মামলা যোগ হয়েছে অনন্ত সিংহের নামে। মোকামার ‘দবং নেতা’ দুলারচাঁদ যাদবের খুনের মামলা। একদা লালু প্রসাদের ঘনিষ্ঠ ‘ডন’ দুলারচাঁদের নামেও খান আষ্টেক খুন, অস্ত্র আইনের মামলা ছিল। অধুনা বুড়ো বয়সে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মোকামা টাল এলাকায় জন সুরাজের প্রার্থী পীযূষ প্রিয়দর্শীর হয়ে প্রচার করছিলেন। একই সময়ে ৪০ গাড়ির কনভয় নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছিলেন অনন্ত সিংহও। দুই গোষ্ঠীর খণ্ডযুদ্ধের মধ্যেই প্রথমে দুলারচাঁদের পায়ে গুলি লাগে। তারপর গাড়ির চাকায় তাঁকে পিষে ফেলা হয়। অভিযোগ, অনন্ত সিংহই ‘মার দো’ বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ বারের বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম রাজনৈতিক ‘খুন’। নির্বাচন কমিশন রাজ্য পুলিশের ডিজি-র কাছে রিপোর্ট তলব করেছে।
এত দিন বিজেপি-জেডিইউ অভিযোগ তুলছিল, তেজস্বী যাদবের সরকার ফিরলে লালুপ্রসাদ জমানার ‘জঙ্গলরাজ’-ও ফিরবে। তেজস্বী পাল্টা প্রশ্ন তুলছিলেন, নীতীশ কুমারের রাজত্বে যে রোজ খুনজখম হচ্ছে, সেটা কি ‘জঙ্গলরাজ’ নয়? মোকামার খুন বিহারের ‘জঙ্গলরাজ’-এ নতুন করে প্রচারের আলো ফেলেছে। অভিযোগের কাঠগড়ায় জেডিইউ-রই প্রার্থী অনন্ত সিংহ। তেজস্বী যাদবের মহাগঠবন্ধন নীতীশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র পেয়ে গিয়েছে।
গুরুদেব টোলার জেডিইউ শিবিরে অনন্ত নেই। খুনের এফআইআরে নাম জড়ানোয় প্রচার বন্ধ রেখেছেন। অনন্তের দাবি, তাঁর ‘পুরনো শত্রু’ সুরজভান সিংহই দুলারচাঁদকে খুন করিয়ে তাঁকে ফাঁসানোর চক্রান্ত করেছেন। কে সুরজভান? মোকামার আর এক ভূমিহার ‘বাহুবলী’। এক সময়ের কুখ্যাত গ্যাংস্টার। প্রাক্তন সাংসদ। একসময় গোরক্ষপুর থেকে মোকামা পর্যন্ত রেলের ঠিকাদারিতে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে জনশ্রুতি। তাঁর নামেও খুন, অপহরণ, তোলাবাজির অজস্র মামলা। জেলও খেটেছেন। প্রাক্তন মন্ত্রী ব্রিজবিহারী প্রসাদের খুন থেকে শুরু করে পুলিশের উপরে গুলি চালানোর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত বলে নির্বাচনে লড়তে বাধা। তাই স্ত্রী বীণা দেবীকে আরজেডি থেকে প্রার্থী করেছেন। ঠিক যেমন অনন্ত তিন বছর আগে অস্ত্র আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিধায়ক পদ চলে যাওয়ার পরে স্ত্রী নীলম দেবীকে উপনির্বাচনে জিতিয়ে বিধায়ক করে দিয়েছিলেন।
অনন্তের অনুগামী কানহাইয়া সিংহ বলছিলেন, “নব্বইয়ের দশকে মোকামায় মিঠাইয়ের দোকানে কথা কাটাকাটি হলেও গোলাগুলি চলত। ভূমিহার বনাম যাদব গ্যাংস্টারদের মধ্যে এলাকা দখলের লড়াই হত। এ রকমই গোলাগুলিতে আমার বাবা বলরাম সিংহও খুন হয়ে গিয়েছিলেন। ভূমিহারদের ডন সুরজভানের উপরে সে সময়ের কুখ্যাত যাদবদের গ্যাংস্টার অশোক সম্রাট একে-৪৭ নিয়ে হামলা করেছিল। সুরজভানের পায়ে এখনও গুলির ক্ষত রয়েছে। সুরজভান ও অনন্ত দু’জনেই ভূমিহার। কিন্তু দু’জনের মধ্যে পুরনো রেষারেষি।”
অপরাধের দুনিয়া থেকে রাজনীতিতে আসা অনন্ত এবং সুরজভান অনেকবার দল বদলেছেন। অনন্ত এখন নীতীশের অনুগামী। তাঁর ভরসায় পটনা জেলার ভূমিহার ভোট ঝুলিতে পুরতে চায় জেডিইউ। তেজস্বীও ভূমিহার ও ব্রাহ্মণ ভোট জিততে সুরজভানকে দলে নিয়েছেন। সুরজভানের স্ত্রী বীণা মোকামায় অনন্তের বিরুদ্ধে ভোটে নেমেছেন।
মোকামার ব্যালট বাক্সের লড়াইয়ে কি আরও বুলেট চলবে? না কি দুলারচাঁদের খুনের বদলা নিতে আবার খুন হবে? সুরজভানের স্ত্রী বীণার দাবি, “আমার স্বামীর সঙ্গে আর অপরাধের সম্পর্ক নেই। আমি ওঁকে বদলে দিয়েছি। ভোটে জিতলে মোকামারও ভোল বদলে দেব।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)