E-Paper

দেহগুলি সব গেল কোথায়

এখন প্রশ্ন উঠেছে, সেই বিস্ফোরণের পরে উপস্থিত মানুষগুলো সব গেল কোথায়? তাঁদের মরদেহইবা কই? বিমান ভেঙে পড়ার তিন দিন পরেও সেই সব মানুষের খোঁজ মিলছে না বলে তাঁদের পরিবারের অভিযোগ।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ০৭:২৪
প্রায় ছাই হয়ে যাওয়া বিমানের অংশ সরানো হচ্ছে ক্রেন দিয়ে। রবিবার আমদাবাদে।

প্রায় ছাই হয়ে যাওয়া বিমানের অংশ সরানো হচ্ছে ক্রেন দিয়ে। রবিবার আমদাবাদে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

একটি ভবন কিছুটা তফাতে। তার পরের চারটি ভবনের দূরত্ব কম-বেশি দেড়শো মিটার। এই মাঝের জায়গাটুকুতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা থাকত দিন কয়েক আগেও। জায়গাটাকে স্থানীয়েরা কেউ চেনেন ‘রোজগার কাছারি’, কেউ ‘মেন্টাল বাড়ি’ নামে। সেখানে পরপর সার দিয়ে ছিল ত্রিপল খাটানো দোকান। আদালতের উকিল থেকে মুহুরি, নানা ধরনের মানুষ টেবিল পেতে প্রিন্টার, কম্পিউটার খুলে বসতেন সেখানে। কেউ আধার কার্ড, প্যান কার্ড করাতে ভিড় করতেন, কেউ আসতেন অন্য কোনও জরুরি কাগজের জন্য। সে দিনও ছিল একই রকম ভিড়। দুপুরের ব্যস্ত সময়ে সেই ভিড়ের মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে বিশাল বিমান। পিষে, হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্তে ঘটে বিস্ফোরণ।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, সেই বিস্ফোরণের পরে উপস্থিত মানুষগুলো সব গেল কোথায়? তাঁদের মরদেহইবা কই?

বিমান ভেঙে পড়ার তিন দিন পরেও সেই সব মানুষের খোঁজ মিলছে না বলে তাঁদের পরিবারের অভিযোগ। তাঁরা হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন হাসপাতালের এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে। কখনও আবার বিমান ভেঙে পড়া জায়গাটার আশেপাশে। কোথাওই ঢুকতে পারছেন না তাঁরা। মিলছে না পরিজনের খোঁজও। ক্ষোভে, আতঙ্কে তাঁদের অনেকেই বলছেন, ‘‘মানুষগুলো কোথায় গেল? মারা গেলে অন্তত মরদেহ তোপাওয়া যাবে?’’

আমদাবাদে বিমান ভেঙে পড়ার ঘটনায় কত জনের ঠিক মৃত্যু হয়েছে, সেই তথ্য নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। গুজরাত পুলিশ-প্রশাসনের তরফেও স্পষ্ট করে কিছুই বলা হচ্ছে না। রবিবার গুজরাত সরকার জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ২৭৪ জনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। কিন্তু কতগুলি মৃতদেহ তারা উদ্ধার করতে পেরেছে, সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। আমদাবাদ সিভিল হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, মৃত্যুর এই সংখ্যাটা ৩২০-রও বেশি। যদিও বিমান ভেঙে পড়া এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, এই সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। সে দিন ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা অনেকেরই খোঁজ মিলছে না। যে ভাবে করোনা বা কুম্ভে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যাটা স্পষ্ট করা হয়নি, এ ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।

ক্ষোভ উগরে দিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়েরা বলছেন, ‘‘কোথায় গেলে কিছু জানতে পারব, সেটাই বুঝতে পারছি না। প্রশাসনের থেকে কোনও উত্তর পাচ্ছি না। ডিএনএ মিলিয়ে দেখার ব্যাপারে বহু কথা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিয়ে কেউই ভাবছেন না। আমাদের কথাটুকু শোনার কারও সময় নেই। অথচ নেতারা বলে যাচ্ছেন, প্রতিটাজীবন গুরুত্বপূর্ণ।’’

হাসপাতাল চত্বরেই দেখা মিলল অজয় সুরেশভাই পরমারের মা রঞ্জনাবেনের। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে ছেলের খোঁজে ছুটে চলেছেন তিনি। বলেন, ‘‘সরকারি পরীক্ষার ফর্মপূরণ করতে ওখানে গিয়েছিল। তার পর থেকে আর খোঁজ নেই। হাসপাতালেই রাতদিন বসে আছি, কেউ কোনও তথ্য দিচ্ছেন না।’’ সঙ্গীত সওয়ারডেকার আবার খুঁজে চলেছেন স্বামী ললিতকে। তাঁর কথায়, ‘‘শুনছি তিনশোর কাছাকাছি লোক মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে কি আমার স্বামীও আছে? উত্তর পাচ্ছি না।’’ হাসপাতাল চত্বরেই বসা সদ্য ১৪ বছরের ছেলেকে হারানো সুরেশভাই পাটানি আবার বললেন, ‘‘ওখানে অনেক লোক আধার, প্যান কার্ড তৈরির কাজে আসেন। ওখানে চায়ের দোকান চালাতাম আমরা। ছেলে আর আমার স্ত্রী চায়ের দোকানেই ছিল। এমন আগুন জ্বলে ওঠে যে, ছেলেটাকে ঠেলে বার করে দেয় ওর মা। সে নিজেও পুড়ে গিয়েছে। এখন এখানে বার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি। কিন্তু ছেলের খোঁজ পাচ্ছি না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তাও আমার স্ত্রী ভর্তি বলে ছেলের কথা শুনছেন কেউ কেউ। কিন্তু অন্য যাঁরা একা ছিলেন, যাঁদের খোঁজ নেই, তাঁদের পরিবারের কথা কেউ শুনছে না। জানতে চাইলে বলে দেওয়া হচ্ছে, দেখুন গিয়ে, আগেই হয়তো ওখানে থেকে বেরিয়ে গিয়েছে! বা বলা হচ্ছে, নিজেরাই খুঁজুন।’’

জানা গেল, বিমানটি যেখানে ভেঙে পড়েছে, এক কালে সেখানে আদালত ভবন ছিল। এর পর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড করানোর কাজ হত সেখানে। পরে সরকারিএই জমিতে বি জে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেল তৈরি হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে হস্টেলের মেস ভবনের উপরের তলে প্রথম ধাক্কা খায় বিমানের পিছনের অংশটি। সেটি ভেঙে আলাদা হয়ে মেসের ক্যান্টিনের ভিতর ঢুকে যায়। এর ঠিক দেড়শো মিটারের মধ্যে পরপর চারটি বহুতল ভবন রয়েছে ডাক্তারি পড়ুয়াদের থাকার জন্য। কিন্তু সেখানে না পড়ে বিমানের সামনের অংশ গিয়ে পড়ে ওই ভবনগুলির পাশের ফাঁকা জমিতে। সেখানেই সেই সময়ে বাইরের লোকজন নানা কাজে উপস্থিত ছিলেন বলে স্থানীয়দের দাবি। দেখা যাচ্ছে, পরপর চারটি ভবনের উপরে না পড়ে পাশের জমিতে বিমান পড়ায় ভবনগুলি ভেঙে পড়েনি। কিন্তু বিশাল জ্বালানি থাকায় বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ ঝলসে গিয়েছে ভবনগুলি। ভেঙে পড়েছে ডাক্তারি পড়ুয়াদের মেসের সামনের অংশ। পিছনের অংশে বিমানের লেজ ঢুকে যাওয়ায় ভেঙেছে সেই দিকটিও। কিন্তু ভবনটির ছাদ রয়েছে অটুট।

এর মধ্যে থেকেই এ দিন ক্রেন দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভেঙে পড়া বিমানের সামনের ইঞ্জিনের দিকের অংশ। সেখান থেকেই মেলে কিছু দেহাংশ। সেগুলিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় এক মহিলার আকুতি, ‘‘আমার মেয়ের নাকি? একবার দেখতে দিন দয়া করে। তিন দিন ধরে ওর কোনও খোঁজ পাচ্ছি না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ahmedabad Plane Crash plane accident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy