মৃত্যুর সঙ্গে চিরশান্তির একটা ধারণা জড়িত আছে। মধ্যপ্রদেশের গঁড় জনজাতির লোকজন মৃত্যুকে ক্রিয়াপদে বোঝাতে হলে বলেন, শান্ত হয়ে যাওয়া। ‘‘এই ঘরেই ও শান্ত হয়ে গেল!’’ আশ্চর্য নির্লিপ্ত স্বরে বলছিলেন পঞ্চাশের কোঠা ছোঁয়া মানুষটি। যাঁর সম্পর্কে বলছিলেন, তিনি ওঁর স্ত্রী, ওঁর সন্তানদের মা। এ বছর মে মাসের শেষ দিকে ঘটনাটা ঘটে, সংবাদমাধ্যমের ভাষায় যার পরিচিতি হয় খান্ডোয়া গণধর্ষণ মামলা বা মধ্যপ্রদেশের নির্ভয়া মামলা বলে।
খান্ডোয়া জেলাটা মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে, মহারাষ্ট্র ঘেঁষা। অতএব মাটির রং কালচে। কাপাস, সয়াবিন আর ভুট্টার চাষবাসই বেশি। ঘটনাস্থল সম্পর্কে তথ্য বলতে জানা ছিল শুধু রোশনি পুলিশ চৌকির নাম। জেলাশহর থেকে তার দূরত্ব দেড় ঘণ্টার মতো। সেখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার ভিতরে ঢুকলে তবে নির্যাতিতার গ্রামে পৌঁছনো যায়। রোশনি বাজারের পাশের রাস্তাটা ধরলে ২০০ মিটারের মধ্যে গলাগলি করে আছে সন্ত টেরিজা গির্জা, হনুমান মন্দির আর জামে মসজিদ। সে সব ছাড়িয়ে ছোট নদীসেতু পার হয়ে ইটাওয়া গ্রামে পা দেওয়া গেল। সব মিলিয়ে ১০০-১২০ ঘরের গ্রাম, অধিবাসীদের বেশির ভাগই গঁড় আর কোরকু জনজাতির।
গ্রামে একটা বিয়েবাড়ি ছিল। কয়েক দিন ধরে গ্রামের লোকজন মেতেছিলেন তাই নিয়ে। ঘটনাটা ঘটে গেল ২৩ মে, উৎসবের শেষ রাতে। নির্যাতিতার স্বামী সে দিন অনুষ্ঠান বাড়িতে যাননি, কাজ করছিলেন খেতে। রাতে স্ত্রী না ফেরায় চিন্তা করেননি খুব। ধরেই নিয়েছিলেন, গ্রামেই কারও বাড়িতে আছেন। যে রকম হচ্ছিল কয়েক দিন যাবৎ। অনুমান ভুলও ছিল না। ৪৫ বছরের ওই মহিলা সে দিন পড়শি হরিদের বাড়িতে ছিলেন। সুনীল নামে আর এক ব্যক্তিও সেখানে ছিল। উৎসবের রাতে মদ্যপান করা হয়েছিল সকলে মিলেই। গ্রামবাসী এবং পুলিশের বক্তব্যে হেরফের নেই এ ব্যাপারে। নেশাগ্রস্ত হরি এবং সুনীল ভোররাতে পড়শি মহিলাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। সকালে হরির মা-ই আবিষ্কার করেন, বেহুঁশ শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পরিবারকে খবর দিয়ে ধরাধরি করে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। মাটি লেপা মেঝেতে উবু হয়ে বসা স্বামী ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে বলে চলেন, ‘‘তখন ওর কিছুটা জ্ঞান এসেছিল। হরি আর সুনীলের নাম বলল। একটু জল খেল। তার পর ধীরে ধীরে শান্তহয়ে গেল।’’
শুধু ধর্ষণ করা হয়নি ওঁকে। যৌনাঙ্গের মধ্য দিয়ে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনা হয়েছিল নাড়িভুঁড়ি। সুরতহালের প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে স্তম্ভিত ছিল পুলিশও। নির্ভয়ার স্মৃতি আরও একবার উস্কে ওঠে এই বীভৎসতার সূত্রেই। ২৪ মে রোশনি চৌকিতে খবরটা প্রথম পান এসআই সুশা পারতে। পুলিশ আসতে দেখে হরি আর সুনীল গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। বেশি দূর যেতে পারেনি, ধরা পড়ে দ্রুত। তদন্তভার যায় খালওয়া থানার হাতে। খালওয়া পুলিশ, খান্ডোয়া জেলা পুলিশ, খরগোন রেঞ্জ— নড়াচড়া পড়ে যায় সর্বত্র। বিরোধী দল কংগ্রেস অভিযোগ তোলে, মধ্যপ্রদেশে পরপর ভয়ানক সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এ রাজ্য আবার ‘ধর্ষণের রাজধানী’ হয়ে ওঠারদিকে এগোচ্ছে!
২০১১ থেকে ২০১৮— ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের নিরিখে টানা আট বার দেশে এক নম্বরে ছিল মধ্যপ্রদেশ। তার পর ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১-এ সেই ‘খেতাব’ চলে যায় রাজস্থানের কাছে। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে ধর্ষণ যে ফের বাড়ছে, বিশেষ করে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায়, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বছর মার্চ মাসে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় রাজ্য সরকার ২০২৪ সালের যে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ওই বছর মধ্যপ্রদেশে নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ৭২৯৪। ২০২০-র বার্ষিক রিপোর্টে সংখ্যাটা ছিল ৬১৩৪। ২০২৩-এর রিপোর্টে ৫৩৭৪। বছর শেষেই সেটা ৭২০২-এ পৌঁছে যায়। এনসিআরবি-র প্রকাশিত এখনও অবধি শেষ রিপোর্টে অর্থাৎ ২০২১-এর পরিসংখ্যানে এক নম্বরে থাকা রাজস্থানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ছিল ৬৩৩৭। মধ্যপ্রদেশ দ্বিতীয় স্থানে ছিল ২৯৪৭টি নথিভুক্ত ধর্ষণ নিয়ে। অর্থাৎ চার বছর আগে যে সংখ্যাটা ছিল তিন হাজার ছুঁই ছুঁই, গত বছরে সেটাই সাত হাজার ছাড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসনের বক্তব্য— মানুষের সচেতনতা বাড়ছে, বেশি অভিযোগ নথিভুক্ত হচ্ছে, তাই পরিসংখ্যান বাড়ছে। কিন্তু শহর এলাকায় এই সচেতনতা তো নতুন নয়। ধর্ষণ কিন্তু বেড়েছে সেখানেও। ২০২৪-এর বার্ষিক রিপোর্টই বলছে, ইন্দোর শহরে ধর্ষণ বেড়েছে ১০৩ শতাংশ, ভোপালে ৫৯ শতাংশ। ঘটনাচক্রে এই দুটো শহর পরিচ্ছন্নতার মাপকাঠিতে দেশে এক এবং দুই নম্বরে। ভোপালে মেয়েদের প্রতি হিংসা প্রতিরোধে কাজ করছে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান, প্রার্থনা শর্মার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মধ্যপ্রদেশের পুলিশ থানায় মহিলা হেল্প ডেস্কের অফিসারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ওঁরা। প্রার্থনা বললেন, ‘‘শুধু অভিযোগ নথিভুক্তি বাড়ছে বললে নিশ্চয় সবটা পরিষ্কার হয় না। অপরাধ না হলে তো আর নথিভুক্তির প্রশ্ন আসে না! এবং এখনও অনথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি।’’ তবে হ্যাঁ, প্রার্থনা মানছেন, ‘‘গত তিন-চার বছরে পুলিশের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। থানায় মহিলা হেল্প ডেস্ক আগের থেকে বেশি সক্রিয়। ওয়ান স্টপ সেন্টারগুলো কাজ করছে। মহিলাদের মামলায় পুলিশের ব্যবহার আগের থেকে ভাল হয়েছে। বিশেষ করে কমবয়সি অফিসারদের ব্যবহার তুলনামূলক ভাবে ভাল।’’
তা হলে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমার বদলে ঊর্ধ্বমুখী কেন? আদিবাসী এবং দলিতদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার মাধুরী কৃষ্ণস্বামীর মতে, মধ্যপ্রদেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই জীবিকার অভাব বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিযান। সমাজের চেনা বাঁধুনি আলগা হচ্ছে। জনসম্প্রদায়ের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারি ভেঙে পড়ছে। মহিলাদের প্রতি হিংসা বাড়ার এটা একটা অন্যতম কারণ। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের বক্তব্য, প্রশাসন ও পুলিশের দিক থেকে কোনও ব্যবস্থা নেই, এমন নয়। কিন্তু সেগুলো যে ভাবে কাজ করা উচিত, সে ভাবে করছে না। সমন্বয়ের অভাব, তৃণমূল স্তরে প্রচারের অভাব, উপযুক্ত তদারকির অভাব। জুন মাসে খান্ডোয়া জেলারই মান্ধাতা থানা এলাকার ঘটনাটি দেখলে ছবিটা স্পষ্ট হবে। স্কুলে শৌচালয় আছে— অথচ তাতে জল নেই, দরজা নেই, মাথায় ছাদ নেই। একটি ছাত্রী মাঠে শৌচকার্য করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার। পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পেরেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তার স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীকে একটি নিরাপদ শৌচালয় দিতে পারেনি।
প্রশ্ন হল, নিরাপদ শৌচালয় থাকলেই কি ধর্ষণ এড়ানো যেত? ধর্ষণেচ্ছু পুরুষ কি অন্য কোনও সুযোগ খুঁজে নিত না? সরোবর ঘেরা ভোপাল শহরে বড়া তালাওয়ের সুদীর্ঘ জলরাশি সেই প্রশ্ন ডুবিয়ে দিতে পারে না। কারণ তালাওয়ের ধারেই নিখাদ সৌন্দর্যায়নের খাতিরে রাখা আছে একটি নোটিস বোর্ড— মনের ইচ্ছা সরোবরকে জানানোর জন্য। চোখ আটকে যায়— একটি মেয়ের নাম লিখে নিজের রিরংসার কথা লিখে রেখেছে কোনও বীরপুঙ্গব। প্রকাশ্য রাস্তায় প্রকারান্তরে ধর্ষণের হুমকি লিপিবদ্ধ করে রাখার আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধা লালন করে যে সমাজ, তা কী ভাবে ধর্ষণমুক্ত হবে?
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)