E-Paper

পোসেরামরা কি বোড়ে, প্রশ্ন তুলে দেয় ছবি বদলের সেতু

ছত্তীসগঢ়ে পরপর ‘সংঘর্ষে’ প্রাণ যাচ্ছে মাওবাদীদের। কেন? স্থানীয়, আদিবাসীরা কি মুখ ফেরাচ্ছেন?

কিংশুক গুপ্ত ও দেবরাজ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ১০:০০
দন্তেওয়াড়ার চেরপাল পঞ্চায়েতের ছোটে কারকা গ্রামে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে পুলিশ এবং সিআরপির পাহারায়।

দন্তেওয়াড়ার চেরপাল পঞ্চায়েতের ছোটে কারকা গ্রামে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে পুলিশ এবং সিআরপির পাহারায়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

চেয়েছিলেন যোগাযোগের সেতু। সেই ‘অপরাধে’ গণ আদালতে ‘পুলিশের চর’ তকমা দিয়ে মাওবাদীরা চরম শাস্তি দিয়েছিল সরপঞ্চ পোসেরাম কশ্যপকে। ইন্দ্রাবতী নদীর উপর নতুন সেতুর নাম এখন ‘স্বর্গীয় শ্রী পোসেরামকশ্যপ সেতু’।

বছর তিনেক আগে সাড়ে ছ’শো মিটার সেতুটি তৈরি হয়েছে। অথচ বছর সাতেক আগেও এই নদীর স্রোত বয়ে নিয়ে যেত গ্রামবাসীর হতাশা, যন্ত্রণা আর মৃত্যু। সে গ্রামের নাম ছিন্দনার। দন্তেওয়াড়ার গিদম তহসিলের সেই জনজাতি গ্রাম, যেখানে এক সময় প্রশাসনের নাম উচ্চারণ করাও ছিল ‘অপরাধ’।

ইন্দ্রাবতীর এ পারে ছিন্দনার। নদীর ও পারে চেরপাল, ছোটে কারকা, তুমরিগুন্ডা, পাহুরনার, কউরগাঁওয়ের মতো প্রায় তিরিশটি গ্রামের সঙ্গে দন্তেওয়াড়ার সহজ যোগাযোগ ছিল না। নৌকাই ছিল ভরসা। পোসেরাম সমস্যাটা বুঝেছিলেন। তাই প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করে ইন্দ্রাবতীর উপর সেতু চেয়েছিলেন। কিন্তু খবর পৌঁছে গিয়েছিল মাওবাদীদের কাছে। পর দিন ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই, দিনের আলোয় গ্রামের মাঝমাঠে গণআদালত বসিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল পোসেরামকে। বড় ছেলে ধনীরাম বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর জখম হন। ছোট ছেলে কেশব তখনও কিশোর। বাবার সেই মৃত্যুকথা কাঁটার মতো বিঁধে আছে দুই ভাইয়ের মনে।

আজ নদীর উপর দাঁড়িয়ে পোসেরামের নামাঙ্কিত সেতু। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সেতুর উদ্বোধন করেছিলেন ছত্তীসগঢ়ের তৎকালীন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল। গ্রামবাসীরা জানালেন, পোসেরামের নামাঙ্কিত ওই সেতুর এক দিকে ভূপেশ বঘেল, অন্য দিকে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রীর ছবি ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিজেপি সরকার আসার পর সেই ছবি খুলে ফেলে বর্তমান বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেও সাই এবং পূর্তমন্ত্রী অরুণ সাও-এর ছবি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, সরকার বদল হলে ছবিও বদলে যায়, এটাই এখানকার দস্তুর।

প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় এখানে পিচের রাস্তা। গ্রামে পৌঁছলে চোখে পড়ে পানীয় জল প্রকল্প, সিআরপি ক্যাম্প। বস্তার ফাইটার্স এবং ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড (ডিআরজি)—এর টহলদারি, গ্রামবাসীদের সঙ্গে বাহিনীর সদস্যদের কথাবার্তা এখন নিত্যদৃশ্য।তা সত্ত্বেও ছিন্দনারের বর্তমান সরপঞ্চ নাম বলতে রাজি নন। বছর পঁয়তাল্লিশের মানুষটি বললেন, “এখন আমরা ভাল আছি। কিন্তু বেশি কিছু বলতে চাই না। জানি না, এখনও ওরা কোথায় লুকিয়ে আছে। পোসেরামের পরিণতি আমরা কেউই চাই না।” মাথা নেড়ে সায় দিলেন আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ-ছ’জন গ্রামবাসী। তাঁরা জানাচ্ছেন, পুলিশ ও বাহিনীর উপস্থিতিতে বহিরঙ্গে দৃশ্যপট পাল্টেছে। গ্রামের দেওয়াল থেকে মাও স্লোগান উধাও। বদলে গোলাপফুলের ছবি। স্কুলের পাঠ শেষ করে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এখন দান্তেওয়াড়ার কলেজে পড়ছেন। মাওবাদীদের হাতে নিহত পোসেরামের বড় ছেলে ধনীরাম এখন জেলা পুলিশের কনস্টেবল, ছোট ছেলে কেশব ডিআরজি-র কনস্টেবল। তবু দু’ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকার ঝুঁকি নেন না।

ইন্দ্রাবতী নদীর উপর পোসেরামের নামাঙ্কিত সেতু। কংগ্রেস আমলে তৈরি হওয়া সেতুতে ২০২৩ সালের পরে মুখ্যমন্ত্রী ও পূর্তমন্ত্রীর ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে।

ইন্দ্রাবতী নদীর উপর পোসেরামের নামাঙ্কিত সেতু। কংগ্রেস আমলে তৈরি হওয়া সেতুতে ২০২৩ সালের পরে মুখ্যমন্ত্রী ও পূর্তমন্ত্রীর ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

ধনীরামের কথায়, “মাওবাদীরা এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চায় না। গ্রামবাসীকে গ্রামে আটকে রেখে এবং তাঁদের সামনে রেখে আড়ালে থেকে সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ করাই মাওবাদীদের উদ্দেশ্য।’’ আর কেশব বলছেন, ‘‘বাবার মতো অসংখ্য মানুষকে মাওবাদীরা নির্বিচারে পিটিয়ে, কুপিয়ে, ফাঁসি দিয়ে খুন করেছে। সেই সব মৃত্যুর বদলাআমরা নিচ্ছি।’’

দান্তেওয়াড়ার ডিএসপি (বস্তার ফাইটার্স) গোবিন্দ দিওয়ান বলছিলেন, “বছর সাতেক আগেও এই সব এলাকায় ঢোকা যেত না। এখন গ্রামে গ্রামে বাহিনীর শিবির হয়েছে। উন্নয়ন কাজ চলছে জোর কদমে। এলাকার মানুষ আর মাওবাদীদের সঙ্গে নেই।’’

সত্যিই কি তাই? ছিন্দনার থেকে ইন্দ্রাবতী নদীর সেতু উজিয়ে কিলোমিটার পাঁচেক যাওয়ার পরই দু’পাশে জঙ্গল। ইতিউতি টিলা আর দূরে পাহাড়ের সারি। ছোট ছোট জনপদ। কিন্তু ছিন্দনারের তুলনায় বড্ড বেশি শুনশান। কাঁচা রাস্তার দু’পাশে জঙ্গলে অস্ত্র হাতে সিআরপি জওয়ানরা। দেখা গেল, চেরপাল পঞ্চায়েতের ছোটে কারকা গ্রামে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সেই কারণেই এমন সতর্কতা। চারপাশে সিআরপি, ডিআরজি (ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড) এবং বস্তার ফাইটার্স-এর নজরদারি। বৃদ্ধা মাগলি মরকমের কথায়, “এখন এলাকায় প্রশাসন সর্বক্ষণ থাকছে। এই যে এত পুলিশ, সিআরপি দেখছেন। দিনরাত ওদের পাহারায় রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ছিন্দনার পর্যন্ত সমস্যা নেই। তবে ছোটে কারকা হয়ে পাহাড়ের দিকের গ্রামগুলিতে এখনও ওদের প্রভাব রয়েছে।’’

২০০৫ সালে বিজেপির সরকার থাকাকালীন মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগঠিত করে ‘সালওয়া জুড়ুম’ (শুদ্ধি-অভিযান) গড়ে তোলেন দন্তেওয়াড়ার কংগ্রেসি বিধায়ক মহেন্দ্র কর্মা। গোন্ডি ভাষায় যার অর্থ 'শুদ্ধি অভিযান', অথবা 'শান্তি অভিযান'। আদতে তা ছিল কার্যত রাষ্ট্র সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী তথা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন। ওই সময়ে বিজেপির সরকার থাকলেও কর্মার এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু মাওবাদীদের শত্রু হয়ে যান মহেন্দ্র। ২০১১ সালের ৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট ‘সালওয়া জুড়ুম’কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বন্ধের নির্দেশ দেয়। দু’বছর পর ২০১৩ সালের ২৫ মে কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’ শেষ করে ফেরার সময়ঝিরম ঘাঁটি এলাকায় মাওবাদীদের অতর্কিত হামলায় মহেন্দ্র কর্মা এবং তৎকালীন ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নন্দকুমার পটেল সহ ২৭ জন কংগ্রেস নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়। ঝিরম ঘাঁটিতে ২৭ জনের ছবি দিয়ে শহিদ স্মারক হয়েছে। স্থানীয় তোংপাল গ্রামের শালখান সিং বলছেন, ‘‘মহেন্দ্র ‘বস্তার টাইগার’ ছিলেন। উনি জীবিত থাকলে হয়তো অন্য রকম কিছু হত। মাওবাদী সন্ত্রাস, সালওয়া জুড়ুম পেরিয়ে এখন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, বাহিনী যাতে ওই সব এলাকায় পৌঁছতে পারে। যোগাযোগের উন্নতির ফলে যাতে মানুষের সুবিধা হয়। আখেরে কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য মাওবাদীদের হত্যা করা।’’

তা হলে কি পোসেরামের মতো সরকারি প্রশাসনের লোকজনকে 'বোড়ে' হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? একটি সেতুর আবেদনপত্র, আর তার বিনিময়ে মৃত্যু। তারপর এলাকায় বাহিনী দিয়ে রাস্তা তৈরি, বাহিনীর শিবির। এ ভাবে কি সমস্যা মিটিয়ে এলাকাকে মাওবাদী মুক্ত করা সম্ভব? প্রশ্ন উঠছে এবং উঠছে।

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Maoists Chhattisgarh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy