বছর শেষে বিহারের ভোট। সেই নির্বাচনেও মহারাষ্ট্রের মতো কারচুপি হতে চলেছে বলে অভিযোগ করলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। পাশাপাশি, মহারাষ্ট্রে কী ভাবে কারচুপি হয়েছে এবং তাতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী ছিল— তা নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি। যদিও অতীতের মতো এ বারও যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে নির্বাচন কমিশন। বিজেপির অবশ্য পাল্টা যুক্তি, কংগ্রেস যখন হিমাচলপ্রদেশ, তেলঙ্গানার নির্বাচনে জেতে তখন কমিশনের কোনও দোষ খুঁজে পান না রাহুল গান্ধী।
অতীতে দেশে ও দেশের বাইরে গিয়ে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে সরব হতে দেখা গিয়েছে রাহুলকে। আজ দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে কী ভাবে কারচুপি হয়েছে তা বিশদে তুলে ধরেছেন তিনি। রাহুলের দাবি, মহারাষ্ট্রের ভোটে মূলত পাঁচটি ধাপে কারচুপি করা হয়েছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্যানেলে গঠন। ওই প্যানেল স্থির করার প্রশ্নে কেন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে স্থান করে দেওয়া হল— তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাঁর মতে, এর ফলে তিন সদস্যের ওই কমিটির (প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) মাধ্যমে সরকার প্রতিবারই নিজের পছন্দমতো লোককেই নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করতে সক্ষম হবে। দ্বিতীয়ত, তালিকায় ভুয়ো ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা। রাহুলের দাবি, ২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রের ভোটার সংখ্যা ছিল ৮.৯৮ কোটি। যা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বেড়ে হয় ৯.২৯ কোটি। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে ভোটার বাড়ে ৩১ লক্ষ। কিন্তু লোকসভা ভোটের ছয় মাসের মধ্যে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয় ৯.৭০ কোটি। সেই হিসাবে ছয় মাসে ভোটার বাড়ে ৪১ লক্ষ। রাহুলের অভিযোগ, এদের অধিকাংশই ভুয়ো ভোটার। তৃতীয়ত, মহারাষ্ট্রে ভোটের দিন বিকেল পাঁচটায় ভোটদানের হার ও চূড়ান্ত ভোটদানের হারের মধ্যে প্রায় ৭.৮৩ শতাংশ পার্থক্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। হিসাব মতো যা প্রায় ৭৬ লক্ষ ভোট। চতুর্থত, বিজেপি দুর্বল এমন কেন্দ্রে ভোটার বাড়ানো হয়েছে। যার ফলে লোকসভা নির্বাচনে যে কেন্দ্রগুলিতে বিজেপি পিছিয়ে ছিল, সেগুলিতে ভাল ফল করতে সক্ষম হয় গেরুয়া শিবির। রাহুলের পঞ্চম অভিযোগ তথ্যপ্রমাণ লোপাট নিয়ে। তাঁর দাবি, আইন করে ভোটের সময়কার ভিডিয়ো ফুটেজ প্রকাশ্যে আনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতেই এটা করা হয়েছে।
যে কৌশলে মহারাষ্ট্রে ‘হারা ম্যাচ’ বিজেপি জিতে নিয়েছে— রাহুলের আশঙ্কা, বিহারেও একই কৌশল নিতে চলেছে গেরুয়া শিবির। রাহুলের কথায়, ‘‘কেবল বিহার নয়, যেখানে যেখানে বিজেপির হার নিশ্চিত সেখানেই ম্যাচ ফিক্সিং করে জেতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।’’ বিজেপি নেতৃত্বের পাল্টা বক্তব্য, রাহুলের অভিযোগ বুঝিয়ে দিচ্ছে, বিহারে বিরোধীরা লড়াই করার মতো অবস্থায় নেই। বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা বলেন, ‘‘বিভিন্ন রাজ্যে ধারাবাহিক ভাবে হারের কারণে এ হল রাহুল গান্ধীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ।’’ তাঁর মতে, মহারাষ্ট্রে লোকসভায় খারাপ ফল করেছিল বিজেপি। কিন্তু কয়েক মাস পরেই বিধানসভা ভোটে বিজেপির ঘুরে দাঁড়ানো মেনে নিতে পারছেন না রাহুল। বিজেপির আইটি শাখার মুখপাত্র অমিত মালবীয়ের কথায়, ‘‘ভারত বিরোধী ধনকুবের জর্জ সোরসের পরিকল্পনামাফিক ওই ধরনের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন রাহুল। সোরসের পরিকল্পনা হল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির যোগ্যতা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন তুলে জনমানসে সেগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করা।’’
নির্বাচন কমিশন আজ ফের জানিয়েছে, রাহুলের যাবতীয় অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাদের মতে, মহারাষ্ট্রে ভোট চলাকালীন কোনও রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্ট কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। স্ক্রুটিনির সময়েও অভিযোগ জমা পড়েনি। অভিযোগ জমা পড়েনি নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের কাছেও। ভোটার তালিকায় কারচুপির অভিযোগও খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। তাদের বক্তব্য, তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ২৭,০৯৯ জন বুথ পর্যায়ের কর্মীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কমিশনের দাবি, কোনও ভুল তথ্য ছড়ানো শুধু আইনকে অসম্মান করাই নয়, লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মীর পাশাপাশি দলগুলি যে রাজনৈতিক কর্মীকে ভোটের কাজে নিয়োগ করে তাদেরও অসম্মান। ভোটাররা বিপক্ষে ভোট দিলেই, নির্বাচন কমিশন আপস করেছে বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা অনুচিত। কমিশনের একটি সূত্রের বক্তব্য, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর কংগ্রেসকে পাঠানো নির্বাচন কমিশনের বিস্তৃত চিঠির পরেও রাহুল গান্ধী কমিশনকে সরাসরি কোনও চিঠি লেখেননি। বরং তাঁর অর্থহীন সন্দেহকে নিয়ে বারবার বক্তব্য রেখে চলেছেন এবং সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি করছেন। কী কারণে রাহুল গান্ধী কমিশনকে সরাসরি চিঠি লিখছেন না এবং জবাব পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না সেই প্রশ্ন উঠছে।
নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে সমাজমাধ্যমে রাহুল অবশ্য আজ পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, গোপন করার কিছু না থাকলে কী কারণে একটি স্বাক্ষরবিহীন বক্তব্য কমিশনের নামে প্রচার করা হল? পাশাপাশি, তিনি দু’টি দাবিও রেখেছেন কমিশনের কাছে। রাহুলের দাবি, গোটা দেশের লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য একটি ডিজিটাল ভোটার তালিকা সামনে আনা হোক। এছাড়া, মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে বিকেল পাঁচটার পর যে ভোট হয়েছে, তার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করা হোক। রাহুলের কথায়, ‘সত্য লুকিয়ে নয়, প্রকাশেই বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)