Advertisement
E-Paper

রতন-সাইরাস যুদ্ধে হাতছাড়া হতে পারে সিংহাসন, উদ্বিগ্ন পার্সিরা

রতন টাটা বনাম সাইরাস মিস্ত্রি। দুই পার্সির মধ্যে তুমুল লড়াইকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলেও এখন গভীর উদ্বেগের ছায়া। কিন্তু আরও একটি মহল রয়েছে, যাঁরা এই লড়াইতে অত্যন্ত বিষণ্ণ, তবে সম্পূর্ণ অন্য রকম কারণে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৬ ১৪:১৫

রতন টাটা বনাম সাইরাস মিস্ত্রি। দুই পার্সির মধ্যে তুমুল লড়াইকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলেও এখন গভীর উদ্বেগের ছায়া। কিন্তু আরও একটি মহল রয়েছে, যাঁরা এই লড়াইতে অত্যন্ত বিষণ্ণ, তবে সম্পূর্ণ অন্য রকম কারণে। তাঁরা হলেন ভারতীয় পার্সি সম্প্রদায়। দুই পার্সির লড়াই যে ভাবে সর্বসমক্ষে চলে এসেছে, তাকে ঘরোয়া আবর্জনা প্রকাশ্যে আসার ঘটনা হিসেবেই দেখছেন পার্সিরা। আরও একটা আশঙ্কা চারিয়ে গিয়েছে তাঁদের মধ্যে। রতন-সাইরাস লড়াইয়ের জেরে ইতিহাসে প্রথম বার টাটা সন্সের সর্বোচ্চ পদ পার্সি সম্প্রদায়ের হাতছাড়া হতে পারে। সেই সম্ভাবনাই আশঙ্কার মেঘ হয়ে চারিয়ে গিয়েছে পার্সিদের আকাশে।

উত্থান হয়েছিল যাঁর হাত ধরে, তাঁর নাম সাইরাস। সাম্রাজ্য আজ টালমাটাল যাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নামও সাইরাস। সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট আর তাঁর সুবিশাল পারস্য সাম্রাজ্য আজ শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়। আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে যা পারস্য ছিল, আজ তা ইরান। সে দেশেও পার্সি (জরাথুস্ট্রীয়) জনগোষ্ঠীর শাসন নেই এখন। গোটা পৃথিবীতে জরাথুস্ট্রীয় ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এখন ১ লক্ষ ৩০ হাজারের কাছাকাছি, যাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ভারতে। পার্সিরা ঠাট্টা করে বলে থাকেন, পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানীটা ইরান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখন ভারতে চলে এসেছে।

কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি ঠাট্টার নয়। ভারতকে পার্সিদের রাজধানী বলা হলে, মোটেই খুব ভুল বলা হয় না। ১২৫ কোটির দেশে যে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার, সমানুপাতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিচার করলে কিন্তু তাঁরা অন্য যে কোনও ভারতীয় সম্প্রদায়কে অনেক পিছনে ফেলে দিতে পারেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালী ভারতীয়দের তালিকায় বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছেন পার্সিরা। টাটা, গোদরেজ, শাপুরজি-পালোনজি, সিরাম ইনডাস্ট্রিজ— ভারতীয় শিল্প মানচিত্রের রথী-মহারথীদের একের পর এক নাম পার্সি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। নামী সুরকার, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, স্বনামধন্য আইনজীবী— ভারতকে অনেক কিছুই দিয়েছে এই সম্প্রদায়। সেই সমৃদ্ধি ধরে রাখার প্রশ্নে ভারতীয় পার্সিরা বেশ যত্নবানও। কিন্তু সপ্তাহ দু’য়েক ধরে গভীর সঙ্কটে পার্সি পরিবার। টাটা সন্সের শীর্ষ পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রির অপসারণকে ঘিরে টালমাটাল পার্সি সমাজ।

২৪ অক্টোবর, ২০১৬ টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন সাইরাস মিস্ত্রি। তার পর থেকেই সঙ্কটের শুরু। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে সরগরম গোটা দেশের শিল্প মহল। কিন্তু, কে ঠিক, কে ভুল, সে বিতর্ক এক পাশে সরিয়ে রেখে পার্সি সম্প্রদায়ের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অন্য একটি প্রশ্ন। পরবর্তী চেয়ারম্যান কে হচ্ছেন? রতন টাটা অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান পদে বসেছেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে নতুন চেয়ারম্যান বেছে নিয়ে রতন টাটাকেও সরে যেতে হবে। ভারতের সবচেয়ে বড় পার্সি প্রতিষ্ঠান তথা দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠীগুলির অন্যতম টাটা সন্সের হাল তা হলে এ বার কে ধরবেন? কোনও অ-পার্সি? তেমনটা কিছুতেই চাইছেন না পার্সিরা।

ভারতীয় পার্সিদের ৯০ শতাংশই মুম্বইতে থাকেন। বাকি ১০ শতাংশ ছড়িয়ে রয়েছেন গোটা দেশে। কলকাতায় পার্সি জনসংখ্যা শ’চারেকের কাছাকাছি। কিন্তু বম্বে হাউজের দখল কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে কলকাতার পার্সিরা মুম্বই নিবাসীদের চেয়ে বিন্দুমাত্র কম ভাবিত নন। কলকাতা হাইকোর্টে খ্যাতনামা আইনজীবী ফিরোজ এদুলজির ফেসবুক পেজেই তা স্পষ্ট। গত এক সপ্তাহ ধরে তাঁর টাইমলাইনে যা কিছু পোস্ট, প্রায় সবই টাটা গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিয়ে। কোন দিকে গড়াচ্ছে সঙ্কট? প্রায় তার প্রতিটি মুহূর্তের বিবরণ তুলে ধরা রয়েছে ফিরোজ এদুলজির ফেসবুক পেজে। কিন্তু সে তো ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ। টাটার ভবিষ্যতের প্রশ্নে এদুলজিদের ইচ্ছাটা ঠিক কী? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বললেন, ‘‘টাটা খুব বড় এবং পেশাদার একটি সংস্থা। নিজেদের নিয়ম-কানুন মেনেই তারা পরবর্তী চেয়ারম্যান বাছবে। কিন্তু আমি হৃদয় থেকে চাইছি, কোনও পার্সিই সংস্থার শীর্ষ পদে বসুন।’’

শুধু কলকাতার আইনজীবী ফিরোজ এদুলজি নন, মুম্বই পার্সি পঞ্চায়েতের প্রধান দিনশ মেহতার কণ্ঠেও একই সুর। সাইরাসকে যে ভাবে সরানো হয়েছে, তা নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে মেহতার। কিন্তু সে সব বিতর্ক আপাতত এক পাশে সরিয়ে রেখেছেন দিনশ। বলছেন, ‘‘টাটা হল পার্সিদের উত্তরাধিকার এবং আমরা আশা করি এক জন পার্সিই চেয়ারম্যান পদে বসবেন। আমরা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের কাউকে টাটার শীর্ষ পদে চাই না।’’

পার্সিরা না চাইলেও, টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদের জন্য অন্য কোনও পার্সিকে খুঁজে বার করা কিন্তু কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। টাটার মতো সুবিশাল সংস্থার শীর্ষ পদে বসার জন্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। কিন্তু সেই পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন কাউকে ছোট্ট জনগোষ্ঠীটার মধ্যে থেকে খুঁজে বার করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাটা গোষ্ঠীর পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে যে কয়েক জনের নাম উঠে আসছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র একটি নাম পার্সি— নোয়েল টাটা। রতন টাটার সৎ ভাই তথা সাইরাস মিস্ত্রির ভগ্নিপতি হলেন নোয়েল। কিন্তু পার্সিদের মধ্যেই নোয়েলকে নিয়ে মতভেদ রয়েছে। জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পত্রিকা ‘পারসিয়ানা’র সম্পাদক জাহাঙ্গির পটেল নাম না করেও নোয়েলে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাঁর মন্তব্য, ‘‘টাটা গোষ্ঠীর ভিতরে হোক বা বাইরে, পার্সিদের মধ্যে এমন আর কেউ নেই, যাঁর মধ্যে টাটার শীর্ষ পদে বসার মতো যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে।’’ টাটা সন্সের বোর্ড সদস্যরা নোয়েলকে চাইছেন কি না, তাও স্পষ্ট নয়। বরং সংস্থার বিভিন্ন শাখার প্রধানদের মধ্যে দু’জনের দিকে নজর রয়েছে টাটা সন্সের বোর্ডের। এক জন হলেন তামিল— টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেসের (টিসিএস) প্রধান এন চন্দ্রশেখরন। অন্য জন জার্মান— জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারের শীর্ষকর্তা র‌্যাল্ফ স্পেথ। এঁরা দু’জনেই রতন টাটার ভরসার পাত্র। সাইরাস মিস্ত্রির অপসারণের পর এই দু’জনকে টাটা সন্সের বোর্ড সদস্যও করে নেওয়া হয়েছে। তাই চন্দ্রশেখরন বা স্পেথের মধ্যে কোনও এক জনকে চেয়ারম্যান পদে বসানো হতে পারে বলে জল্পনা শুরু হয়েছে।

এন চন্দ্রশেখরন বা র‌্যাল্ফ স্পেথ চেয়ারম্যান হলে এই প্রথম টাটা সাম্রাজ্যের সিংহাসন পার্সিদের হাতছাড়া হবে। এই বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না গোটা সম্প্রদায়। ঠিক যেমন ভাবে তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না ঘরের কোন্দল বাইরে আসাটা। রতন টাটা বনাম সাইরাস মিস্ত্রির যুদ্ধ যে ভাবে প্রকাশ্য কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাকে পার্সি জাত্যভিমানে আঘাত হিসেবে দেখছেন অনেকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থামুক এই গৃহযুদ্ধ, আর উত্তরাধিকার বর্তাক কোনও পার্সির উপরেই। দেশের প্রায় প্রতিটি পার্সি ঘরে প্রার্থনা আপাতত এই।

আরও পড়ুন: ‘টাটা সন্সের সাফল্যের জন্যই মিস্ত্রিকে সরানোর প্রয়োজন ছিল’

Ratan Tata Vs Cyrus Parsi Community Concerned
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy