Advertisement
E-Paper

ঘরে-বাইরে লড়েই হট সিটে যৌনপল্লির বধূ

এ এক অন্য গুলাব গ্যাং, এ এক অন্য মর্দানি। এ গল্পের নাম ফতিমা খাতুন। নারী পাচার ঠেকাতে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বছর আঠাশের গৃহবধূ। মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সকলেই কোনও না কোনও ভাবে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন থেকে ফতিমা একা লড়াই করে আসছেন।

দীক্ষা ভুঁইঞা

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৪
‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র আসরে অমিতাভ বচ্চন এবং রানি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফতিমা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র

‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র আসরে অমিতাভ বচ্চন এবং রানি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফতিমা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র

এ এক অন্য গুলাব গ্যাং, এ এক অন্য মর্দানি।

এ গল্পের নাম ফতিমা খাতুন। নারী পাচার ঠেকাতে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বছর আঠাশের গৃহবধূ।

মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সকলেই কোনও না কোনও ভাবে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন থেকে ফতিমা একা লড়াই করে আসছেন। নিজেকে বাঁচানোর লড়াই, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের বাঁচানোর লড়াই। ‘মর্দানি’ ছবির শিবানী শিবাজি রায়ের মতো উর্দির জোর ছিল না তাঁর। বিহারের আরারিয়া জেলার ফরবিসগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা প্রায় অসম্ভবই ছিল ফতিমার পক্ষে। কিন্তু সেটাই সম্ভব করে দেখিয়েছেন ফর্সা-ছিপছিপে সাদামাঠা চেহারার মেয়েটি। তাঁর সঙ্গে সিনেমার গল্পের মিল পেয়েই অমিতাভ বচ্চন সম্প্রতি ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র আসরে মুখোমুখি বসিয়েছিলেন রানি মুখোপাধ্যায় এবং ফতিমাকে।

নেপালের নট সম্প্রদায়ের মেয়ে ফতিমা। যাযাবর জীবন, মূলস্রোতের কাছে অস্পৃশ্য। শ্বশুরবাড়িতে বসেই বলছিলেন নিজের জীবনের কথা। পাকা বাড়ি আছে দেখে বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছিলেন কুড়ি বছরের বড় পাত্রের সঙ্গে। ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়ে ফরবিসগঞ্জে এলেন খুদে ফতিমা। এসে দেখলেন, স্বামী অধিকাংশ সময়েই মদ খেয়ে পড়ে থাকেন আর বাড়িতে প্রায়ই নতুন নতুন মেয়ে এসে হাজির হয়। রোজই তিন ননদ আর এই মেয়েদের কয়েক জনকে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখা যায়। অচেনা সব লোক এসে তাদের নিয়ে ঘরে চলে যায়। ব্যাপারটা কী, ছোট্ট ফতিমা বুঝতে পারতেন না। কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহসও ছিল না। প্রায় এক বছর পরে বাইরে থেকে আসা একটি মেয়েই এক দিন ফতিমাকে বলল, ‘‘তোমার স্বামী আর শাশুড়ি যৌন ব্যবসা চালায়।” উনিশ বছর পরেও সে দিনের কথা মনে করলে আজও চোখ ছলছল করে ওঠে ফতিমার।

কিন্তু সব জেনেশুনে চুপ করে থাকার পাত্রী তো ফতিমা নন! এক দিন নেপাল থেকে ১৪-১৫ বছরের তিনটি মেয়েকে বাড়িতে আনলেন স্বামী। ফতিমা তাদের পালানোর পথ করে দিলেন। বড় অঙ্কের টাকা হাতছাড়া হল বলে ফতিমার উপর শুরু হল মারধর। তিন দিন তাঁকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। খাবার-জল কিছুই মিলল না।

ফতিমার লড়াইয়ের সেই শুরু। শারীরিক নির্যাতন, মানসিক পীড়ন কিছুই তাঁকে আটকাতে পারেনি। এক বার ফতিমা আর তাঁর শিশুকন্যাকে মেরে ফেলার চেষ্টাও হয়েছিল বলে ফতিমার অভিযোগ। কিন্তু ফতিমাকে খুন করার জন্য ফতিমার স্বামী যাকে সুপারি দেন, সেই যুবকই ফতিমার পাশে দাঁড়ান। ফতিমার কথায়, “আল্লার মেহেরবানি। মুস্তাফাভাই আমাকে বোন বলে ডাকল। সেই থেকে আমি ওর বোন।” পুলিশের খাতায় মুস্তাফা আজও সমাজবিরোধী। কিন্তু ফতিমার লড়াইয়ে তিনি পাশে রয়ে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে ফতিমার কথা পাড়া-পড়শিরা জেনে যান। দাঁতে দাঁত চেপে যৌন ব্যবসার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন ফতিমা।

গল্পের মোড় ঘুরল ২০০৪ সালে। রামপুর গ্রামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ‘কমিউনিটি সেন্টার’ খোলা হল। যৌনপল্লির দু’-এক জন মেয়ে সেখানে যাওয়া-আসা করছে দেখে ফতিমাও নাম লেখালেন। তৈরি হল মহিলা মণ্ডল, খোলা হল তাঁদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণাধার রুচিরা গুপ্ত বলছিলেন, প্রথম প্রথম কথাই বলতেন না ফতিমা। ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু মিনি-রোশেনারার মতো মেয়েদের দেখে আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শিখলেন। লেখাপড়া জানতেন না। পড়াশোনার বন্দোবস্ত করা হল। ফতিমার জীবন আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করল।

অন্য একটি সংস্থায় ফতিমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও শুরু হল। প্রথম প্রথম স্বামী-শাশুড়ি এ সবে মত দেননি। কিন্তু সংস্থার কাজকর্মে হাতে কিছু পয়সা আসছে দেখে নিমরাজি হলেন। ফতিমা এবং ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চাপে স্বামী নারী-পাচারের ব্যবসাও ছাড়তে রাজি হলেন। কিন্তু তাঁর দাবি, অটো কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকার ধার দিতে হবে। সংস্থার তরফে পাল্টা শর্ত দেওয়া হল, বড় মেয়েকে স্কুলে পাঠালে টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। ফতিমার স্বামী রাজি হলেন। পরে একে একে বাকি তিন মেয়েকেও স্কুলে ভর্তি করেন ফতিমা।

ধীরে ধীরে মহল্লার মেয়েদের নিয়ে ফতিমা তৈরি করে ফেলেন দু-দু’টি মহিলা মণ্ডল নারী জাগরণ এবং নারী ক্রান্তি। আরারিয়া জেলার প্রতিটি ব্লকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। কোনও মেয়ের উপরে অত্যাচারের খবর পেলেই মহিলা সদস্যদের নিয়ে পৌঁছে যেতেন ফতিমা। অনেকটা উত্তরপ্রদেশের সম্পত রাই আর তাঁর গুলাব গ্যাং-এর ঢংয়েই অত্যাচারী পুরুষকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যেতেন ফতিমারা। আন্তঃরাজ্য পাচার চক্রের অন্যতম মাথা গেইনুকে এ ভাবেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। ফতিমার দাবি, তাঁর এলাকার ৮০ শতাংশ বাড়ি থেকে যৌন ব্যবসা তুলে দেওয়া গিয়েছে। ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যাচ্ছে। তবু পাচারকারীদের নজরে রয়েছে এই যৌনপল্লি। ফতিমার সঙ্কল্প, “এলাকা থেকে যৌনব্যবসা এবং নারী পাচার বন্ধ করেই ছাড়ব।” মুম্বই থেকে ফেরার পরে আরারিয়া জেলার পুলিশ সুপারও ফতিমার লড়াইকে স্বাগত জানিয়ে ঘোষণা করেছেন যৌনপল্লিতে মেয়ে পাচার বন্ধ করবেন। যে মেয়েরা এখনও বিপদের মধ্যে রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’-র হটসিটে ফতিমা জিতে নিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। ফতিমার স্বপ্ন, “উদ্ধার হওয়া মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করব এই টাকা দিয়ে।” ফতিমার স্বামী অবশ্য তা চান না। তাঁর অটোচালক বন্ধুরা নাকি দাবি করছেন, স্ত্রী ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে যাওয়ার পরে আর অটো চালানো মানায় না। পুরস্কারের টাকা থেকে তাই গাড়ি কেনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্বামী। এক সময় যে ফতিমার উপরে অত্যাচার করতেন, সে কথা আজ মানতে চান না। তবে স্ত্রীর সাফল্যে খুব খুশি, এমনও বলা যায় না। বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা নিয়ে ফতিমাকে মাঝে-মাঝেই ব্যঙ্গ করে যাচ্ছেন তিনি।

ফতিমার প্রতিক্রিয়া? তাঁর গলাতেও খেলে যাচ্ছে করুণ ঠাট্টার সুর, “ক’দিন আগে যাঁরা আমাকেই পারলে বেচে দিতেন, তাঁরা আজ মুখে অন্তত আমার সঙ্গে লড়াইয়ে থাকার কথা বলছেন। এই বা কম কী?”

kbc sex worker bihar fatima
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy