Advertisement
E-Paper

ছাপাখানার সংস্কৃতিতে হারিয়ে গেল বহু রামায়ণ

তখন বলা হল, এটি সরাসরি সংস্কৃত থেকে অনূদিত। ফলে এই বয়ানটিই সত্য। মুখে ও পুঁথিতে প্রচলিত বহু স্থানীয় আখ্যান চাপা পড়ে গেল। আধুনিকতার সেই বিষাক্ত জ্বালা আজকের গণতন্ত্রেও! সব্যসাচী ভট্টাচার্যতখন বলা হল, এটি সরাসরি সংস্কৃত থেকে অনূদিত। ফলে এই বয়ানটিই সত্য। মুখে ও পুঁথিতে প্রচলিত বহু স্থানীয় আখ্যান চাপা পড়ে গেল। আধুনিকতার সেই বিষাক্ত জ্বালা আজকের গণতন্ত্রেও! সব্যসাচী ভট্টাচার্

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:২০
প্রামাণ্য: রামায়ণের পরিচিত ছবি। স্বল্প-পরিচিত বহু রামায়ণ হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে

প্রামাণ্য: রামায়ণের পরিচিত ছবি। স্বল্প-পরিচিত বহু রামায়ণ হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে

আমার লেখা শুরু করব আধুনিক যুগের দু’জন বিশেষ ব্যক্তিত্বের কথা দিয়ে। একটু অন্য ধরনের মানুষ তাঁরা। এক জন বাংলার কবি মধুসূদন দত্ত, এবং অন্য জন কন্নড় কবি এ কে রামানুজন। মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টার হিসেবে সফল হননি। আর ১৯৬৮-’৬৯ সালে যখন রামানুজনের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, মৃদুভাষী মানুষটি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক। মধুসূদন দত্ত রামায়ণকে ভিত্তি করে একটি মহাকাব্য লিখতে শুরু করেন। সেটা তেমন কিছু আশ্চর্যের বিষয় ছিল না, কারণ তখন শ’য়ে শ’য়ে কবি এ ধরনের লেখালিখি করতেন। কিন্তু মধুসূদন দত্তের স্বাতন্ত্র্য এইখানে যে, তিনি তাঁর কাব্যে রাবণকে এক জন বীর হিসেবে উপস্থাপিত করলেন, আর তাঁর রামের চরিত্রলক্ষণ হল বীরত্বের উলটো। এটা সে কালের হিন্দুদের মনে খুবই আঘাত করেছিল। কিন্তু ১৮৬০ সালের জুলাই মাস থেকে ১৮৬১’র অগস্ট পর্যন্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়, তখন সেই প্রকাশনায় কেউ বাধা দেয়নি। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদন দত্তের কয়েকটি চিঠিতে সেটা স্পষ্ট।

মধুসূদন দত্তের কাব্যে রাবণকে বীরের রূপ দেওয়া এবং রামকে দুর্বল চরিত্র রূপে প্রতিষ্ঠা করার ফলে হিন্দুদের মনে নিশ্চয়ই আঘাত লেগেছিল, কিন্তু সেই আঘাতের বহিঃপ্রকাশ সীমিত ছিল কিছু সমালোচনামূলক প্রবন্ধে। অথচ, এর ঠিক দেড়শো বছর পরে ২০১১ সালে রামানুজন-এর ‘থ্রি হানড্রেড রামায়ণস’ প্রবন্ধটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক বিবাদ ফেনিয়ে উঠল। ২০০৮ সালে এক দল লোক রামানুজনের এই প্রবন্ধ কেন সিলেবাসে থাকবে, এই প্রশ্ন তুলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভাঙচুর করে। দিল্লি হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশনও দাখিল করা হয়, যাতে অভিযোগ করা হয়, প্রবন্ধটি অশ্লীল এবং ধর্মদ্রোহসূচক। আদালত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করার নির্দেশ দেয়। ২০১১ সালে প্যানেল সুপারিশ করে যে, প্রবন্ধটি পাঠ্যসূচিতে থাকুক। (প্যানেলের সদস্যদের মধ্যে তিন জন এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দেন, এক জন বিপক্ষে) কিন্তু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রবন্ধটিকে পাঠ্যসূচিতে রাখা হবে না। কাউন্সিলের ১২০ জন সদস্য চেয়েছিলেন প্রবন্ধটি বাদ দেওয়া হোক, মাত্র দশ জন চেয়েছিলেন সেটি সিলেবাসে থাকুক।

এই সিদ্ধান্তে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সিলেবাস থেকে রামানুজনের প্রবন্ধটি বাদ পড়ে যায়। মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য এখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে আছে।

২০১১-র পুরো ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষয় হিসেবে দেখা হবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু তার বাইরে বেরিয়ে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিতের দিকে নজর দেওয়া যাক। রামায়ণের নানা কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, তার নানা ব্যাখ্যাও রয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সেই সমস্ত বিশ্লেষণকে স্থান দেওয়া হয়েছে। ফলে এটা শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রশ্ন নয়, কাহিনি এবং তার ব্যাখ্যার বহুত্বের প্রতি এবং সেই বহুত্বকে যে সংস্কৃতি ধারণ করে এসেছে তার সহিষ্ণুতার প্রশ্ন।

মধুসূদন দত্তের সঙ্গে রামানুজনের তফাতটা বোঝা জরুরি। মধুসূদনের কাব্যে রাম উপস্থাপিত হয়েছেন একটি দুর্বল চরিত্র হিসেবে। আর রামানুজন তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন, রামায়ণ একটা নয়, বহু বিভিন্ন রামায়ণ প্রচলিত আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধুসূদন দত্তের কাব্যে রামকে অবজ্ঞা করে রাবণকে যথার্থ বীরের আসনে বসানো হয়েছে। মধুসূদন তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমি রাম ও তাঁর আলতু-ফালতু লোকলস্করকে ঘেন্না করি।’ আর তাঁর রাবণকে হয়তো দেখা যায় এক জন দেশভক্ত বীর হিসেবে, যিনি নিজের মাতৃভূমিকে বিদেশি শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অন্য দিকে, এ কে রামানুজন এমন কিছুই করেননি, তিনি রামকে বীরের আসন থেকে নামিয়ে ছোট করে দেখাননি। তিনি কেবল বলেছেন যে, রামায়ণের গল্প অতীতে নানা ভাবে বলা হয়েছে। তাঁর প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে তামিল ভাষায় রচিত কম্বন-এর রামায়ণের পার্থক্য রয়েছে।

আবার জৈনদের রামায়ণের ব্যাখ্যা অন্য রকম। জৈন লেখকরা মনে করতেন, ব্রাহ্মণরা তাঁদের রামায়ণে রাবণকে হেয় করেছেন। এবং তাই আমরা দেখি, বিমলাসুরি-র রামায়ণে রাবণ রাজা এক মহান তপস্বী, তিনি জৈন গুরুদের উপাসনা করেন। আবার, দক্ষিণ ভারতীয় লোককথায় এবং অন্যান্য রচনায় সীতা হলেন মহানায়িকা, রামের চেয়ে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে। আর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত রামকাহিনিতে রাম ষোলো আনা মানুষ— তিনি বীর, কিন্তু তাঁর চরিত্রে কোনও ঐশ্বরিক শক্তি আরোপিত হয়নি। রামানুজন কেবল এই বহু রামায়ণের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধে। আর তাতেই হিন্দু আবেগের, বা তথাকথিত হিন্দু আবেগের ধ্বজাধারী কিছু লোকের তীব্র রোষের শিকার হন তিনি। এর দেড়শো বছর আগে কবি মধুসূদন দত্তকে কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

মজার কথা হল, এই ধরনের আক্রমণ মধুসূদনের ওপর হওয়াই ছিল বেশি স্বাভাবিক। কারণ তিনি খ্রিস্টান হয়েছিলেন এবং ‘মাইকেল’ নাম গ্রহণ করেছিলেন।

অন্য দিকে, যত দূর জানা আছে, এ কে রামানুজন আর পাঁচটা হিন্দুর মতোই এক জন হিন্দু। ইতিহাসবিদদের কাছে অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন এই যে, মধুসূদন তাঁর লেখালিখি ও সেই লেখা প্রকাশের সময় যতটা সহিষ্ণুতার বাতাবরণ পেয়েছিলেন, আর তার দেড়শো বছর পরে এ কে রামানুজনের প্রবন্ধ যে অসহিষ্ণুতার শিকার হল, এই দুই অভিজ্ঞতা এতটা আলাদা হল কেন।

এই প্রশ্নের দু’ধরনের উত্তর হতে পারে। একটা উত্তর সন্ধান করা যায় ভারতে তথাকথিত নবজাগরণের মধ্যে, রামমোহন থেকে যার শুরু। বলা যেতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর এই নবজাগরণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটা উদারতা এনেছিল, মধুসূদনের মতো স্রষ্টা যার কল্যাণে নিজস্ব সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু আমার মতে, এই ব্যাখ্যাটি যথেষ্ট নয়। রামমোহন রায় প্রচলিত হিন্দু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেছিলেন এবং তার পরবর্তী পর্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন— দু’জনকেই কট্টর হিন্দুদের প্রতিরোধ এবং শত্রুতার মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সহিষ্ণুতার পরিবেশ তাঁরা পাননি।

অন্য দিকে, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনে মুসলমানদের স্থান দেওয়া হয়নি, তাঁরা কী চাইছেন তা নিয়ে এই আন্দোলনের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীর অন্তর্দৃষ্টি সহকারে সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। আসলে, নিজেদের নবজাগরণের উত্তরসূরি বলে দাবি করা ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীর সত্তা ছিল জটিল, তাঁদের মধ্যে আদর্শগত অবস্থানের বৈচিত্র ছিল বিস্তর, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দেখলে, চিত্তরঞ্জন দাশের হিন্দু-মুসলমান বোঝাপড়ার উদ্যোগ যে বাংলায় জনসমর্থন পায়নি, এবং ১৯৪৭-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের আগে মুসলমান সত্তার ক্রমশ গড়ে ওঠা আত্মসচেতনতার প্রতি ভূস্বামী হিন্দু ভদ্রলোকের মনোভাবে এমন সহমর্মিতা দেখা যায়নি, যা নবজাগরণের মানসিক উত্তরাধিকারীদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। সহিষ্ণুতার সীমা ছিল। সুতরাং, মধুসূদন যে রামানুজনের অভিজ্ঞতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন, তা নবজাগরণের সুফল হিসেবে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না।

অন্য উত্তরটি একটু ভিন্নধর্মী। এমনটা কি সম্ভব যে, বাংলায় তথা ভারতে যে বৈচিত্রময় স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছিল, নবজাগরণের ফলে সেগুলির বিভিন্নতা চাপা পড়ে গিয়ে এক ছাঁচে ঢালা একটা সাংস্কৃতিক কাঠামো তৈরি হল? এবং তার ফলে সমাজে ওপরতলার মানুষজনের সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব কায়েম হল, যাঁরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, যাঁদের দখলে ছিল সামাজিক পুঁজি এবং বই ছাপাবার ক্ষমতা? তাঁরা আর ইউরোপীয় কিছু পণ্ডিত মিলে মূল সংস্কৃত থেকে বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করতে থাকেন। এই উচ্চবর্গের মানুষরা যে উচ্চ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করলেন, তা সচরাচর লোকায়ত ও স্থানীয় সংস্কৃতিকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। (নীচের তলার বইয়ের বাজারের জন্য অবশ্য সস্তা এবং হেলাফেলা করে ছাপা নানা প্রকাশনা চলছিলই।) এটা বলা যেতে পারে যে, বিংশ শতাব্দীর উচ্চবর্গের বাঙালি স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রান্তিক করে ফেললেন এবং তার পরিণামে, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বহুত্ব ছিল তা ভুলতে থাকলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, মধুসূদন দত্তের সময়েও, পুরনো সাংস্কৃতিক বহুত্বের ধারা বজায় ছিল। রামায়ণের বিবিধ আখ্যান প্রচলিত ছিল বাংলায়। বাংলায় রামায়ণ লেখার পথিকৃৎ কবি কৃত্তিবাসও মূল সংস্কৃত রামায়ণ থেকে অনেক পরিবর্তন করেছিলেন। পরে, রামকথা বা যাত্রায় নানাবিধ আখ্যান পরিবেশন করা হত। ষোড়শ শতাব্দীতে চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখেছিলেন মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রামের কঠোর সমালোচনা এবং সীতার মর্মান্তিক দুঃখের খুব অনুপুঙ্খ বর্ণনা করা ছিল চন্দ্রাবতীর রামায়ণে। পিতৃতন্ত্রের যে সমালোচনা পরবর্তী কালে গড়ে উঠবে, তার একটা আভাস ছিল এই কাব্যে। মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা এই তাৎপর্যপূর্ণ রামায়ণটির কথা আমাদের গোচরে এনেছেন নবনীতা দেব সেন। দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ পাল বংশের রাজা রামপাল-এর সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত লিখেছিলেন। তিনি রামায়ণের কাহিনিটি রাজা এবং রাজবংশের প্রশস্তি আকারে পুনর্লিখন করেন। সেই প্রশস্তি-আখ্যানটিকেও কিন্তু রামের প্রতি কোনও রকম অসম্মান বলে ধরা হয়নি। তখন যাত্রাপালাতেও রামায়ণের বিভিন্ন পর্ব নিয়ে নানা ধরনের উপস্থাপনা করা হয়েছে। যখন সংস্কৃত থেকে সরাসরি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণের রূপান্তর শুরু হয় তখন স্থানীয় রস এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বৈচিত্রগুলি কমে যেতে যেতে একেবারে হারিয়ে যায়।

সংস্কৃত থেকে সরাসরি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ শুরু হয়। যেমন, দক্ষিণ ভারতে কন্নড় (১৮৮৭, ১৮৯৬), তামিল (১৮৭৪, ১৮৮৪, ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৪, ১৯১০), মালয়ালম (১৯০৪) এবং উত্তর ভারতে ফারসি (১৮৭৭), গুজরাতি (১৮৭৫, ১৮৮৬, ১৮৯৩), ওডিয়া (১৮৮০), পঞ্জাবি (১৮৯৫) ইত্যাদি। এর আগে এক জন কথকের মুখ থেকে আরও এক জন, তার পর আরও এক জন— এই ভাবে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া আখ্যান, অন্য প্রজন্মে বয়ে যেত। কিংবা পাণ্ডুলিপি থেকে লেখকরা হাতে লিখে নিতেন। কিন্তু ছাপাখানা আসার পরে এত দ্রুত এত বেশি সংখ্যায় রামায়ণ ছাপা হল এবং ছড়িয়ে পড়ল, যা অতীতে কল্পনার অতীত ছিল। জাক ল্য গফ, স্মৃতি ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর প্রসিদ্ধ বিশ্লেষণে বলেছেন, প্রথমে চার্চ এবং পরে রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যভাণ্ডার তৈরি করল এবং স্মৃতি থেকে যে সব কথা বা উপাখ্যান বলা হত, তা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকল। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘এক্সটিরিয়রাইজেশন’ বা বহিরঙ্গকরণ। কী ভাবে ঘটে এই প্রক্রিয়াটি? প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে, স্মৃতির আধিপত্য ক্রমশই দুর্বল হয়েছে। অন্তরের স্মৃতিকে বন্দি করা হয়েছে নানা বাইরের প্রকরণে— পাণ্ডুলিপিতে, ছাপার অক্ষরে, কম্পিউটারে। ঠিক তেমন করেই, সংস্কৃত থেকে সরাসরি অনুবাদ করে ছাপার অক্ষরে যে সব রামায়ণ প্রকাশিত হল, তাতে চলতি মুখে-বলা আখ্যান বা সাধারণ লেখকদের হাতে লেখা রামায়ণ হারিয়ে গেল।

রামায়ণের ক্ষেত্রে এর মানে দাঁড়াল এই যে, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি হওয়া কথকতা, মুখে-বলা আখ্যান, তার ওপর ভিত্তি করে বহুমুখী ব্যাখ্যা, বাচিক সংস্কৃতি এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য— এই সব কিছুরই দিন শেষ হয়ে গেল। রামায়ণকে নানা দিক থেকে দেখার স্বাধীনতা খর্ব করে বলা হল, প্রামাণ্য রামায়ণের অনুবাদই তার একমাত্র গ্রাহ্য রূপ, কারণ সেই প্রামাণ্য রামায়ণ লেখা হয়েছে সংস্কৃতে, যা হল দেবতাদের ভাষা।

এই প্রক্রিয়ার একটি দৃষ্টান্ত দেব। ২০১০ সালের মার্চ মাসে ‘দ্য হিন্দুস: অ্যান অলটারনেটিভ হিস্টরি’ গ্রন্থের লেখক ওয়েন্ডি ডনিগার এবং বইটির প্রকাশক সংস্থা একটি নোটিস পান। নোটিসে বলা হয়, এই বই ‘রামায়ণকে একটি ফিকশন হিসেবে বর্ণনা করে কোটি কোটি হিন্দুর ভাবাবেগে আঘাত করেছে।’ অভিযোগের যুক্তি হিসেবে নোটিসে বলা হয়েছে, বইটির লেখক বলেছেন, ‘রামায়ণকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে রেখে বিচার করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন মানুষ তার সৃষ্টি করেছেন।’ বলা হয়, এই বই ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারা লঙ্ঘন করেছে। এখন, রামানুজনও একই অপরাধে অপরাধী— তিনিও বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রামায়ণ লিখেছেন। এ এক অসম লড়াই— এক দিকে সাংস্কৃতিক বহুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুরনো স্বাধীনতা, অন্য দিকে শক্তিমান হয়ে ওঠা সামাজিক বর্গের আধিপত্য। এই বর্গটি প্রধানত বড় শহরের উচ্চশ্রেণি, প্রকাশনার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, প্রবল সামাজিক পুঁজি যাদের দখলে।

১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অভিজ্ঞতার সঙ্গে দেড়শো বছর পর এ কে রামানুজনের অভিজ্ঞতার কেমন পার্থক্য ছিল, তার আলোচনা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। এই পার্থক্যের কারণ কী? রামায়ণ নিয়ে তর্কবিতর্কের কাহিনির পিছনে রয়েছে নানা গভীর ঐতিহাসিক প্রশ্ন। একটা ব্যাপার বিবেচনা করা যাক। নিজেকে অনন্য ও প্রশ্নাতীত বলে দাবি করা, সাংস্কৃতিক পরিসরে বহুত্বকে মুছে ফেলা— এগুলো ভাবনার আধিপত্য জারি করার চেষ্টা। এটাই আজ জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ বলে দাবি করা হচ্ছে। মহাত্মা গাঁধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো যাঁরা ভারতীয় মানসের রূপকার ছিলেন, তাঁরা কিন্তু আধিপত্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য নির্মাণের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। গাঁধী তাঁর প্রথম রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘হিন্দ-স্বরাজ’-এ বলেছিলেন, ‘বিবিধের মাঝে মিলন সৃষ্টির ধর্ম’ ভারতের আয়ত্ত। তিনি লিখেছিলেন যে, বৈদিক ধর্ম ও জৈন ধর্মের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, কিন্ত তারা উভয়েই ভারতের ধর্ম। ১৯০৯ সালের এই উক্তি আমাদের সমন্বয়বাদী সমাজের একটা ছবি দেখায়, যে সামাজিক চরিত্রের কথা ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন— সেই ভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতীয় সভ্যতার ঐক্য সম্পর্কে তাঁর চিন্তায়। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ যখন ভারতীয় সভ্যতার ঐক্যের কথা বলেন, তখন তিনি বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপরেই জোর দেন। সাংস্কৃতিক পরিসরে বহুত্ব নিয়ে যদি আমাদের ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতানৈক্য থাকে, তা হলে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর ভাবনার প্রেক্ষিতে নতুন করে ভাবতে হবে। এবং এ বিষয়ে তর্ক উঠবে, যে তর্ক সাদরে বরণীয়।

Republic Day India ভারত রামায়ন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy