ভারতের রাজনীতির মূল স্রোত থেকে নেহরু-গাঁধী পরিবারের আধিপত্যকে সরিয়ে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ‘মুখ’ সামনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংঘ পরিবার। জনসংঘের এই অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষ্যে রাজধানীতে তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হল তাঁকে কেন্দ্র করে পুজো, প্রসাদ বিতরণ পাঁচালি-গান এবং ভারত মাতার পুজো এবং যজ্ঞ।
আরএসএস-এর সদর দফতর দিল্লির ঝান্ডেওয়ালার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে গত তিনদিন ধরে যে ভাবে পুজা পাঠ হল তা দেখে অনেকেরই মনে হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায়কে কার্যত অবতারে পরিণত করল আরএসএস। প্রতিষ্ঠানের বাইরে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। সেখানে গত তিনদিন ধরে দীনদয়ালের স্মরণে প্রসাদ বিতরণ হয়েছে। সিংহের উপর বসে থাকা ভারত মাতার বিশাল ছবি আর ঠিক তার পাশে নিরীহ চেহারার দীনদয়ালের একটি রঙীন আলোকচিত্র। তিনি যা খেতে ভালবাসতেন সেটাই তিনদিন ধরে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ হয়েছে। যেমন যবের খিচুড়ি, ঘি মাখানো আটার রুটি, আলু-কপির তরকারি আর চা পানের সময়ে খাস্তা কচুরি। মনে রাখতে হবে এই সমস্ত খাবারগুলিই এসেছে অর্গানিক ফার্ম থেকে। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯১৬ সালে। আর আজ তাঁর মৃত্যুদিন। এক রেল দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। সেই রেল দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্তের দাবি দীর্ঘদিন করেছে আরএসএস। তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছিল। কিন্তু বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী, যিনি তখন আরএসএস-এর খুব ঘনিষ্ঠ, তিনিই অস্বাভাবিক মৃত্যুর তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছিলেন এবং তদন্তের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দীনদয়ালের এই প্রতিষ্ঠানে তখন থাকতেন আর এক বর্ষীয়ান আরএসএস নেতা প্রয়াত নানাজী দেশমুখ। তিনি এ বিষয়ে আডবাণীকে বেশ কয়েকটি চিঠিও লিখেছিলেন।
গত তিন দিনের এই সংঘের অনুষ্ঠানে আরএসএস-এর মদনদাস দেবী থেকে শুরু করে দত্তাত্রেয় হোসাবালে প্রমুখ নেতারা হাজির ছিলেন। বিজয় গোয়েল থেকে সাহেব সিংহ বর্মার পুত্র পারভেস বর্মা থেকে শুরু করে বেশ কিছু মন্ত্রীও হাজির হন। বাহ্যত এটি সরকারি অনুষ্ঠান নয়। আবার বিজেপি-র দলীয় অনুষ্ঠানও নয়। কিন্তু সংঘের এই পরিকল্পনার পিছনে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। সংঘের পক্ষ থেকে অতুল জৈন বলেন এখানেই শেষ নয়। এই অনুষ্ঠান চলবে আগামি একবছর ধরে। শুধু দিল্লি নয়, এক বছর ধরে বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে এই অনুষ্ঠান পালন করা হবে।
চিত্তাকর্ষক ঘটনা হল দীনদয়ালের নামে পাঁচালি-পাঠের সময়েও পুজার সমস্ত উপাচার নিয়ে বসলেন পাঁচালি গায়ক অলক কুমার। তাতে ছোট সিঁদুর মাখা ঘট, নারকোল, লাল শালু পুজোর সামগ্রী উপাচারের মত করে দীনদয়ালের পুজো করা হল। বন্দেমাতরম গাইল অনুষ্ঠানের সূচনায়। পাশাপাশি দীনদয়ালের একটি প্রদর্শনীও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে ১৯৬৪ সালে দীনদয়ালের সঙ্গে রাম মনোহর লোহিয়ার একটি যৌথ বিবৃতি। যেখানে তিনি বলেছিলেন ‘শুধুমাত্র হিন্দুদের সুরক্ষা নয়, ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিম নাগরিকদেরও সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।’ এমনকি চিনের ভারত আক্রমণের পরেও তিনি বলেছিলেন কংগ্রেস বিরোধিতা করাটা এখন অগ্রাধিকার নয়। চিনের আক্রমণের পর একজোট হওয়া দরকার। ১৯৫৩ সালে লন্ডন সফর করে দীনদয়াল বলেছিলেন ভারতীয় বিদেশনীতি নির্জোট হওয়া উচিত। কোনও বৃহৎ শক্তির লেজুরবৃত্তি করা উচিত নয়। কাজেই সংঘ পরিবার এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং নিরপেক্ষ বিদেশনীতিকেও দীনদয়ালের মাধ্যমে তুলে ধরে রাখতে সচেষ্ট। তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রদর্শনীতে বাজপেয়ীর ছবি থাকলেও আরএসএস ঘনিষ্ঠ লালকৃষ্ণ আডবাণীর কোনও ছবি বা উল্লেখও নেই।
সব মিলিয়ে একটা জিনিস স্পষ্ট। এখন গোটা দেশের মানুষের কাছে নতুন প্যাকেজে দীনদয়ালকে অবতার হিসাবে তুলে ধরতে মরিয়া সংঘ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy