Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Farmers Protest

Farmers Protest: জয়ীদের ঘরে ফেরায় মিশে রইল বিষাদও

প্রবল শীত, বরফের মতো জল ঢুকে যাচ্ছে ট্রাকের উপরে অথবা নিছকই লোহার পাইপে তৈরি করা অস্থায়ী তাঁবু, চট-পাতা বিছানায়। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৫২
Share: Save:

খেলা ভাঙার খেলা!

শুক্রবার রাত থেকেই হরিষে বিষাদ। দিল্লি-হরিয়ানার সীমানা সিংঘু, টিকরিতে। দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানায় গাজ়িপুরে।

প্রবল শীত, বরফের মতো জল ঢুকে যাচ্ছে ট্রাকের উপরে অথবা নিছকই লোহার পাইপে তৈরি করা অস্থায়ী তাঁবু, চট-পাতা বিছানায়। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাকে আরও অন্ধকার করেছে মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ার মতো ঘটনা। কোভিডে উজাড় হচ্ছে দেশ। লু বইছে খোলা হাইওয়েতে।

গত এক বছর দিল্লির সীমানায় এই সবই ছিল নৈমিত্তিক। আর তারই মধ্যে টানা এক বছর রামপুরের সন্তোষ সিংহ, মেরঠের আদিল শেখ, হোশিয়ারপুরের রচপাল সিংহ একসঙ্গে তামাক সেবন করেছেন রাতের পর রাত। লস্যি-লাড্ডু-মকাইয়ের পরোটা ভাগ করে খেয়েছেন। ফুলকপি, মুলো আর কড়াইশুটির বস্তার এ পারে, ও পারে মিলেমিশে গিয়েছে জাত-ধর্ম।

আজ ফিরে যাওয়ার দিন এসেছে এই আন্দোলনভূমি ছেড়ে। চব্বিশ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরেই চলছে লঙ্গর। বিকেলে ট্র্যাক্টরগুলি ফিরবে পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন গ্রামে। শনিবার ভোর থেকেই ট্রাক, ম্যাটাডর, টেম্পো, জিপ-এ অস্থায়ী সংসারের কাপড়-জামা, তাঁবু-কম্বল, বাসন-কোসন, রড-বাঁশ উঠছে। তার মধ্যে যেমন যুদ্ধজয়ের আনন্দ, তেমনই এই যৌথ কৃষক সংসারের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের গল্পও লুকিয়ে।

পঞ্জাবের জালন্ধর থেকে এক বছর আগে দিল্লির সীমানায় এসে প্রায় নতুন করেই ঘর বেঁধেছিলেন সন্তোখ সিংহ। গ্রামের জমিতে গমের চাষ। মোদী সরকারের তিন কৃষি আইনে সব কর্পোরেটের হাতে চলে যাওয়ার ভয়। সন্তোখের তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছোট ছেলে জগতারের তখন দু’বছর বয়স, মায়ের কোলে। তিন বছরের জগতার এখন হাইওয়েতে দৌড়ে বেড়ায়। মেয়ে সুখবিন্দর দশম শ্রেণির ছাত্রী। হাইওয়ের ধারে ট্র্যাক্টর-ট্রলির ‘ঘরে’ বসেই বোর্ডের পড়াশোনা করছে। তবু কিছুই খোয়া যায়নি। সন্তোখ ফিরছেন যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে। জমি থাকলে ‘জাঁহান’ থাকবে।

আগেই ঘোষণা হয়েছিল, শনিবার থেকে কৃষকেরা ঘরে ফেরা শুরু করবেন। শুক্রবার রাত থেকে দিল্লির তিন সীমানায় বিজয়োৎসব। সারা রাত কারও চোখে ঘুম নেই। শনিবার সকালে প্রথমে সিংঘু, তার পরে টিকরি, শেষে গাজ়িপুরে বিজয় মিছিল বা ‘ফতেহ মার্চ’ শুরু হল। নীল পোশাকের নিহঙ্গ যোদ্ধা শিখরা কোমরে তলোয়ার গুঁজে পালকিতে গুরু গ্রন্থ সাহিব তুলে নিলেন। ‘গুরু কি ফৌজ’-এর নামে জয়ধ্বনি উঠল। ঘরে ফেরার পথেও রাস্তায় রাস্তায় ফুল, মিষ্টি নিয়ে কৃষকেরা দাঁড়িয়ে। পঞ্জাব-হরিয়ানার শম্ভূ সীমানায় ঘরমুখো কৃষকদের উপরে আকাশ থেকে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল একটি ছোট বিমান।

উৎসবের মধ্যেও অনেকের মন খারাপ। গাজ়িপুরে বড় বড় ডেকচি লরিতে তুলছিলেন বছর পঁচিশের যুবতী গুরবিন্দর কৌর। উত্তরাখণ্ডের পিথৌরাগড় থেকে বার বার এসে পরিবারকে প্রয়োজনীয় রসদ পৌঁছে দিয়েছেন। থেকেও গিয়েছেন কখনও টানা এক-দু’মাস। গুরবিন্দর বলছেন, “এই জায়গাটার উপরে মায়া পড়ে গিয়েছিল, জানেন! আর কখনও আসব না ভেবে কষ্টই হচ্ছে। এখানে কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হল, সুখ-দুঃখে একসঙ্গে কাটালাম। নম্বর বদলাবদলি করেছি, কিন্তু দেশে ফিরে গেলে আর কি যোগাযোগ থাকবে!”

আর তাঁর পাশেই গুরবিন্দরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন অশীতিপর বৃদ্ধা সাধনা যাদব। তিনি এসেছিলেন মুজফ্‌ফরনগর থেকে, সঙ্গে অশক্ত স্বামী। যত বারই অসুস্থ হয়েছেন, গুরবিন্দর নাকি আপ্রাণ সেবা করে সারিয়ে তুলেছেন বৃদ্ধাকে। অথচ কেউ কাউকে আগে চিনতেনও না। টিকরিতে হরিয়ানার ভবতোষ মানের সঙ্গে আবার এক নেড়ি কুকুরছানার এমন দোস্তি তৈরি হয়েছে যে ভবতোষ ঠিক করেছেন, তাকে নিয়েই গ্রামে ফিরবেন। শনিবারের শীতের দুপুরে হাইওয়ের উপরেই ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়ে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের সদ্য গোঁফ ওঠা একদল দামাল। আর বোধ হয় কোনও দিনও একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা হবে না।

আমেরিকা থেকে ফিরে এসে দিল্লির সীমানায় গত এক বছর চিকিৎসা, ওষুধ বিলি করেছেন স্বাইমান সিংহ। বিদায়বেলায় তিনি সবাইকে ডাক দিয়েছেন, রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হলেও এক টুকরো আবর্জনা কোথাও যেন পড়ে না থাকে। সব সাফসুতরো করেই কৃষকেরা ঘরে ফিরবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farmers Protest Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE