কিছুটা অভূতপূর্ব বটেই! গত কাল লাল কেল্লার বাইরে বিস্ফোরণের পরে চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গি গোষ্ঠী ওই ঘটনার দায় নিতে এগিয়ে আসেনি। তেমনই ওই ঘটনার পিছনে কাদের হাত, সেই প্রশ্নে মুখে কুলুপ নরেন্দ্র মোদী সরকারের। তবে প্রাথমিক ভাবে সরকারের একাংশের দাবি, লাল কেল্লায় এই বিস্ফোরণ কোনও পরিকল্পিত হামলা না-ও হতে পারে। সম্ভবত বিস্ফোরক কোনও নিরাপদ স্থানে সরাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত ওই বিস্ফোরণ হয়ে যায়। তবে কারণ যা-ই হোক, বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩-তে। বেসরকারি মতে যদিও সংখ্যাটি দ্বিগুণের বেশি।
গত কালের এই ঘটনার পিছনে কারা রয়েছে— এটাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন। সরকারের তরফে এখনও এই নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানানো না-হলেও, ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাদের পাকড়াও করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে জইশ-ই-মহম্মদের যোগ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আরও এক দিকে গোয়েন্দাদের একাংশ নজর দিচ্ছেন। তা হল, পুরো চক্রের সঙ্গে যুক্তেরা প্রায় সকলেই ডাক্তার এবং প্রায় সকলেই হরিয়ানার ফরিদাবাদের আল ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত। এর থেকে একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মতে, পহেলগামের ঘটনার পরে সন্ত্রাসবাদের কাঠামো ধ্বংসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালায় ভারত। তাতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জইশ-ই-মহম্মদ। প্রশ্ন উঠেছে, এর পরে কি জম্মু-কাশ্মীর থেকে জইশ নিজেদের পুনর্গঠিত করে পাল্টা হামলার ছক কষে গত কয়েক মাস ধরে, যার কুশীলব মুজ়াম্মিল শাকিল, শাহিন সাহিদ, উমর নবী আর আদিল আহমেদ? গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, মুজ়াম্মিলই এই চক্রের সব থেকে বড় মাথা। সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা থেকে শুরু করে ভারতে থাকা জইশের স্লিপার সেলকে সক্রিয় করা— এই সব কিছুর পিছনে মূল মস্তিষ্ক মুজ়াম্মিল কি না, সেই খোঁজও শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে ছিল শাহিন সাহিদ। যে মহিলা চিকিৎসককে খোদ জইশ-প্রধান মাসুদ আজ়হারের বোন সাদিয়া আজ়হার বেছে নিয়েছিল ভারতে জইশের মহিলা শাখার নেতৃত্বে দেওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, শিক্ষিত মেয়েদের জঙ্গি কার্যকলাপে ব্যবহার করা। সাদিয়ার স্বামী ইউসুফ আজ়হার অপারেশন সিঁদুরে প্রাণ হারায় বলে খবর।
এই পুরো চক্রান্তই গোয়েন্দা-নজর এড়িয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেন্দ্র জানিয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের মগজধোলাই করে নাশকতা চালানোর এই চক্রান্তের বীজ জম্মু-কাশ্মীরে বপণ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে সেই মডিউল ডালপালা মেলে উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায়। যার চরম পরিণতি, দিল্লির লাল কেল্লার সামনে গত কালের বিস্ফোরণ। আজ সারা দিনে স্বরাষ্ট্রসচিব, আইবি প্রধান, জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-এর ডিজি-র সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দিনের শেষে তদন্তের ভার এনআইএ-র হাতে তুলে দেয় কেন্দ্র। পাশাপাশি দেশে জইশ, আনসার গজওয়াতুল হিন্দ-এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির স্লিপার শাখাকে সমূলে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ।
এর পরে মঙ্গলবার রাতে কাশ্মীরে এক স্থানীয় ইমাম, ইরফান আহমদ ওগাহ্কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, জইশের পোস্টারগুলি ইরফানই বিলি করেছিল। শোপিয়ানের বাসিন্দা ইরফান এক সময়ে শ্রীনগরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে প্যারামেডিক বা চিকিৎসাকর্মী হিসাবে কাজ করত। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মুজ়াম্মিল ও উমরের ঘনিষ্ঠ ছিল ইরফান। তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগ ছিল শাহিনের।
এর পাশাপাশি এ দিন পুলিশের দাবি, হামলাকারীকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। গত কাল বিস্ফোরণ হওয়া আই-২০ গাড়িটি চালাচ্ছিল উমর-উন-নবী, যে পুলওয়ামার বাসিন্দা এবং আল-ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক। সিসি ক্যামেরার সূত্র ধরে পুলিশ জানিয়েছে, গত কাল সকাল সাতটা নাগাদ দিল্লি-ফরিদাবাদের সীমানায় বদরপুর টোল প্লাজা দিয়ে শহরে ঢোকে উমরের গাড়ি। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিকেল ৩.১৯ মিনিটে সুনহেরি মসজিদ পার্কিং-এ ঢোকে। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ঠায় গাড়িতেই বসেছিল উমর। তদন্তকারীদের মতে, সকালে যখন দিল্লিতে ঢোকে উমরের গাড়ি, তখনই তাতে বিস্ফোরক বোঝাই করা ছিল। দিনভর বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি নিয়েই দিল্লিতে চক্কর মারে সে। বিকেলে লাল কেল্লার সামনে এসে ওই পার্কিং গাড়ি রাখে।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী ৬.২২ মিনিট নাগাদ সুনহেরি পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে সুভাষ মার্গে ওঠে উমর। তার পরে দিগম্বর জৈন লাল মন্দির, গৌরীশঙ্কর মন্দির পেরিয়ে চাঁদনি চকের ইলেকট্রনিক্স বাজার সিগন্যাল থেকে ফের ‘ইউ-টার্ন’ নেয় উমর। ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ৬.৫২।গাড়ি লাল কেল্লার সমান্তরালঅবস্থানে এলে সিগন্যালে দাঁড়াতেই বিস্ফোরণ হয়। সেই ধাক্কায়ঘটনাস্থলের মৃত্যু হয় উমরের। বিস্ফোরণের অভিঘাতে কার্যত ধ্বংস হয়ে যায় আশপাশের গাড়ি এবং ই-রিকশাগুলি। যাত্রী, পথচারীরা লুটিয়ে পড়েন। মুহূর্তে এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
রবিবার হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয় উমরের সঙ্গী মুজ়াম্মিল, আদিল ও শাহিন। গোয়েন্দাদের একাংশের মতে, উমরের গাড়িতে রাখা বিস্ফোরক মুজ়াম্মিল-আদিলদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। যা ব্যবহার করে পরে অন্য কোনও নাশকতার ছক ছিল তাদের। কিন্তু সঙ্গী তিন জনের গ্রেফতারের খবর জানাজানি হতেই গা-ঢাকা দেয় উমর। গোয়েন্দারা মনে করছেন, গ্রেফতারির হাত থেকে বাঁচতেই সোমবার বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি নিয়ে গোটা দিল্লি চষে বেড়ায় উমর। তার পরে সন্ধ্যায় ওই গাড়িবিস্ফোরণ।
এটি কি পরিকল্পিত হামলা? জবাবে গোয়েন্দাদের একাংশ জানিয়েছেন, ওই পরিমাণ বিস্ফোরক থাকা সত্ত্বেও বিস্ফোরণস্থলে কোনও গর্ত তৈরি হয়নি। বিস্ফোরকে এমন কোনও স্প্লিন্টার (পেরেক, বল-বেয়ারিং, পাথরকুচি) ছিল না, যা ছিটকে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ায়। গাড়ি থেকে যে আইউডি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটিও সম্পূর্ণ কার্যক্ষম ছিল না। ফলে বিস্ফোরকের উপস্থিতির তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, উমর গ্রেফতারি এড়াতে নিজের গাড়িতে থাকা বিস্ফোরক অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া বা লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু গাড়ির গতিরকারণে অসাবধানতাবশত তাতে বিস্ফোরণ হয়ে যায়।
বিস্ফোরণের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় থাকলেও, পুলিশ এফআইআরে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এর ১৬ ধারায় (সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ) ও ১৮ (ষড়যন্ত্রের অভিযোগ) ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছে। এ ছাড়া বিস্ফোরক পদার্থ আইনের ৩ (বিস্ফোরণের কারণে প্রাণহানির সম্ভাবনা) এবং ৪ নম্বর ধারাতেও (বিস্ফোরণের চেষ্টা) অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৩(১) ধারা (খুন), ১০৯(১) (খুনের চেষ্টার) ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। দিল্লি পুলিশ এফআইআরে জানিয়েছে, ‘‘..এটি একটি বোমা বিস্ফোরণ। প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে। যাতে দিল্লি পুলিশের কোতওয়ালি থানার দেওয়ালের একটি অংশ ভেঙে যায়। পুলিশকর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন একাধিকগাড়ি জ্বলছে ও হতাহতেরা মাটিতে পড়ে রয়েছেন।’’
এখন বিস্ফোরণের পিছনের যাবতীয় তথ্য খুঁজে বার করে জঙ্গি মডিউলটির শিকড় পর্যন্ত যাওয়াই গোয়েন্দাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)