Advertisement
E-Paper

কলকাতাতেই খোঁজ মিলল সিদ্ধার্থের

শিনা তাঁর মেয়ে, অন্ধকার রাস্তায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অকপটে কথাটা বললেন। মিখাইলও তাঁর ছেলে, সেটাও জানালেন। এই প্রথম সংবাদপত্রের প্রতিনিধির সামনে তিনি। সিদ্ধার্থ দাস। ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্তন প্রেমিক।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৬

শিনা তাঁর মেয়ে, অন্ধকার রাস্তায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অকপটে কথাটা বললেন। মিখাইলও তাঁর ছেলে, সেটাও জানালেন। এই প্রথম সংবাদপত্রের প্রতিনিধির সামনে তিনি।

সিদ্ধার্থ দাস। ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্তন প্রেমিক।

গত কয়েক দিন সিদ্ধার্থর সম্ভাব্য ঠিকানা নিয়ে জল্পনা কম হয়নি। সোমবার রহস্যের কিনারা হল। জানা গেল, কলকাতাতেই থাকেন সিদ্ধার্থ। তবে বাড়ি তো দূর অস্ত, তার চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড়িয়েও কথা বলতে রাজি ছিলেন না। বাড়ি থেকে অনেক দূরে অন্ধকার এক মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে কথা বললেন। শর্ত ছিল, ছবিতে মুখ দেখানো যাবে না। এখনকার জীবনে অতীতের কোনও আঁচ পড়ে তা চান না সিদ্ধার্থ। স্ত্রী বাবলির সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে তাঁর শান্তির সংসার। সেখানে নতুন করে কোনও কালো ছায়া আসতে দেবেন না তিনি।

তবে আনন্দবাজারের সব প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন। বললেন, ‘‘ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। আমরা লিভ-ইন করতাম ইন্দ্রাণীর গুয়াহাটির বাড়িতে।’’ সেখানেই পরপর দু’বছর (১৯৮৭ ও ’৮৮) শিনা ও মিখাইলের জন্ম। তবে ১৯৮৯ সালের পর থেকে ইন্দ্রাণী বা ছেলেমেয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আর ছিল না বললেই চলে। ক’দিন আগে আর পাঁচ জনের মতো খবরের কাগজ পড়েই প্রথম জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে শিনা খুন হয়েছেন। আর তাঁকে খুনের অভিযোগ উঠেছে তাঁর নিজের মা ইন্দ্রাণীর বিরুদ্ধে। সিদ্ধার্থর কথায়, ‘‘এত বছর পরে এমন খবরে খুব ধাক্কা খেয়েছি। যাই বলুন, সে তো আমার মেয়ে!’’


সোমবার বান্দ্রার কোর্টে মা ইন্দ্রাণীকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বিধি। কোর্টের বাইরে তোলা পিটিআই-এর ছবি।

ঝাঁ-চকচকে জীবন থেকে অনেক দূরে দমদম এলাকায় দু’কামরার এক ঘুপচি ফ্ল্যাটে এখন থাকেন সিদ্ধার্থ। এলাকায় বাবলু নামেই পরিচিত তিনি। জানালেন, ১৯৮৬ সালে শিলংয়ে কলেজে পড়ার সময়ে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আলাপ। তার পরই গুয়াহাটিতে ইন্দ্রাণীর বাপের বাড়িতে লিভ-ইন করতে শুরু করেন তাঁরা। ’৮৭-তে শিনার জন্ম। তার পরের বছরেই জন্ম হয় মিখাইলের (শিনা-মিখাইলকে তাদের দিদার কাছে দত্তক দেওয়ার সময় ইন্দ্রাণী যে হলফনামা দেন, সেখানে অবশ্য জন্মসাল ১৯৮৯ ও ’৯০ লেখা হয়)। এর পরেই সিদ্ধার্থর কথায়, ’৮৯ সালে এক দিন ‘একটু শিলংয়ে যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। তার পরে আর ফেরেননি। সিদ্ধার্থ বলেন, ‘‘ওই তিন বছর আমাদের খুব সুন্দর কেটেছিল। ইন্দ্রাণী চলে যাওয়ার পরে ওকে খুঁজতে শিলং গিয়েছিলাম। খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসি গুয়াহাটিতে। তখন ইন্দ্রাণীর বাবা-মা অপমান করে তাড়িয়ে দেন আমাকে।’’ এর পরে আর ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বলেই সিদ্ধার্থর দাবি। তাঁর কথা যদি সত্য হয়, তবে ইন্দ্রাণী শিলংয়ে কোথায় গিয়েছিলেন এবং কী ভাবেই বা সেখান থেকে কলকাতায় আসেন, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হল। কারণ এর আগে কিছু সূত্রে দাবি করা হয়েছিল, সিদ্ধার্থর ভাইয়ের সঙ্গেই ইন্দ্রাণী পালিয়ে আসেন কলকাতায়। এসে সঞ্জীব খন্নাকে বিয়ে করেন। কিন্তু সিদ্ধার্থর বয়ান তা বলছে না।

ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করেননি সিদ্ধার্থ? তাঁর বক্তব্য, তিনি বেশ কয়েক বার গুয়াহাটির বাড়িতে গিয়েছিলেন। প্রতি বারই অপমানিত হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে বলে দাবি তাঁর। এক বার শুধু শিনার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন। তখন মোবাইল নম্বর দিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে। ২০০০ সালে তেরো বছরের শিনা একবার ফোন করেছিলেন বাবাকে। বলেছিলেন, ‘‘বাবা কেমন আছ?’’ এ রকম দু’একটা কথা। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

পরে আর যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?

‘‘আমি বুঝেছিলাম, ওদের জীবনযাত্রার সঙ্গে আমার অনেক ফারাক। তাই ধীরে ধীরে সরে এসেছিলাম,’’ বলছিলেন সিদ্ধার্থ। বাস্তবিকই। যে মিখাইল মায়ের কাছ থেকে মাসে বারো হাজার টাকা হাতখরচ পেত, তার বাবা এখন বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে বেতন পান ওই বারো হাজারই। সতেরো-আঠেরো বছর হয়ে গেল, বাবলিকে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। বাবলি এত দিন জানতেনও না, এক মহিলার সঙ্গে অসমে ‘লিভ টুগেদার’ করতেন সিদ্ধার্থ। ওই মহিলার দু’টি সন্তান আছে। তারা থাকে দাদু-দিদার কাছে। কলকাতায় বাবলি-সিদ্ধার্থর একটি ছেলে আছে। এ বছরই সে মাধ্যমিক পাশ করেছে। স্বামী-স্ত্রীর আর্জি, ‘‘দয়া করে আমাদের ছবি ছাপবেন না। ছেলের উপরে প্রভাব পড়বে। খবরটা জানা ইস্তক কয়েক দিন ধরে গুম মেরে রয়েছে ও।’’

সিদ্ধার্থর মতোই শিনা হত্যার খবর সংবাদমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছেন বাবলি। তাঁর স্বামী এবং ইন্দ্রাণীর সন্তানই যে মিখাইল ও শিনা— তা-ও জেনেছেন তখনই। বাবলির কথায়, ‘‘টেলিভিশনে দেখে প্রথমে জানতে পারি। মনে হয়েছিল অনেক সিদ্ধার্থ দাসই থাকতে পারে। কিন্তু পরে খবরের কাগজে শাশুড়ির ছবি দেখে নিঃসংশয় হই।’’ সিদ্ধার্থর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়নি? ‘‘ও শুধু বলেছে, এমনটা হোক, আমি চাইনি। কেউই চাইবে না, মেয়ে মারা যাক। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমাদের তেমন যোগাযোগ নেই। কেউ ফোনও করেনি।’’

তবে এত কিছুর পরেও সিদ্ধার্থর প্রতি এতটুকু অসন্তুষ্ট নন বাবলি। বরং বলছেন, ‘‘আমি ওর অতীত না জেনেই বিয়ে করেছি। ও নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আমি সুখী, এটাই বড় কথা। আমি ওকে নিয়েই থাকব।’’ স্বামীর প্রতি বাবলির বিশ্বাস তাই অটুট। তাঁর দাবি, ‘‘ও তো লুকিয়ে কিছু করেনি। ও বলেছে, যবে থেকে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক নেই, তবে থেকে ও কোনও খোঁজ নেয়নি। এমনকী, কলকাতায় যে ইন্দ্রাণী ছিল, সেটাও ও জানত না।’’

বস্তুত ইন্দ্রাণী নয়, শিলংয়ে থাকতে আগে বাবলির সঙ্গেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সিদ্ধার্থর। সেই সময়ে বাবলি ও সিদ্ধার্থ একসঙ্গে স্কুলে পড়তেন শিলংয়ে। বাবলির বাবা যদুগোপাল দত্ত ছিলেন সিপিডব্লুডি-র চাকুরে। শিলংয়ে পোস্টিং ছিল তাঁর। তবে স্কুলে পড়তে পড়তেই বাবা আবার বদলি হন। বাবলি বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। সিদ্ধার্থের সঙ্গে সম্পর্কে ভাটা পড়ে। তার পরেই সিদ্ধার্থের জীবনে এসে পড়েন ইন্দ্রাণী। ও দিকে কলকাতায় এসেও বাবলি কিন্তু সিদ্ধার্থকে ভুলতে পারেননি। বাবলির বন্ধুদের কথায়, ‘‘সুন্দর চেহারার সিদ্ধার্থ খুব স্মার্ট। অনেক ভাষা অনর্গল বলতে পারেন। ইংরেজিতে তুখোড়।’’ ফলে তাঁকে মন থেকে সরানোর কথা ভাবতে পারতেন না বাবলি। শেষমেশ কয়েক বছর পর কলকাতা থেকেই করিমগঞ্জে সিদ্ধার্থের বাড়ির ঠিকানায় একটা ভুয়ো চিঠি লেখেন। নিজেকে এক ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, ব্যবসার জন্য সিদ্ধার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। চিঠি পেয়ে ফোন করেন সিদ্ধার্থ। ফের যোগাযোগ হয় বাবলির সঙ্গে।

এর পরে বাবলির টানে কলকাতায় চলে আসেন সিদ্ধার্থ। একটি কেকের কারখানায় কাজ নেন তিনি। বাবলির সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। শেষমেশ বাড়ির অমতেই বাবলি বিয়ে করেন সিদ্ধার্থকে। বাবলিরা তিন বোন— বুলু, বাবলি আর নানু। এর মধ্যে বাকি দুই বোনের ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল। হয়নি শুধু বাবলির। তাঁর মায়ের কথায়, ‘‘ওর বিয়েতে আমাদের মত ছিল না। নমো নমো করেই ওদের বিয়ে হয়েছিল।’’

বিয়ের পরে দমদমে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন বাবলি আর বাবলু। বাবলির বাপের বাড়ির কাছেই। নির্দিষ্ট সূত্র মেলার পরে সোমবার প্রথমে বাবলির বাপের বাড়িরই খোঁজ মেলে। দেখা হয় তাঁর বাবা-মার সঙ্গেও। বাবলির বাবা অসুস্থ, শয্যাশায়ী। মা কথাই বলতে চাননি। এমনকী বাবলিরা কোথায় থাকেন, তা নিয়েও মুখ খোলেননি। বলে দেন, ‘‘আমার মেজো মেয়ে কোথায় থাকে, জানি না।’’ এর পরে বাবলির পড়শিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, কাছেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন তাঁরা।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি শোনার পরে প্রথমে অপ্রস্তুত ছিলেন বাবলি। পরে মুখ খোলেন। তিনি এখন চিন্তিত ছেলেকে নিয়ে। ছেলেকে বুঝিয়েছেন, ‘‘জ্ঞান হওয়ার পরে বাবাকে যেমন দেখেছ, সে ভাবেই বাবাকে বিচার করবে।’’ একই সঙ্গে বাবলির দাবি, ‘‘আমরা চাই, সুবিচার হোক। সব সত্য সামনে আসুক। তার জন্য যদি কোনও সাহায্য প্রয়োজন হয়, অবশ্যই করব।’’ সিদ্ধার্থও তৈরি আছেন যে, পুলিশ তাঁকে যে কোনও সময় যোগাযোগ করতে পারে। বললেন, ‘‘মেয়ের মৃত্যুর খবরে কষ্ট তো হবেই। আমি তদন্তে সব রকম সহযোগিতায় রাজি।’’

প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ, পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

MostReadStories sidhratha das sheena mikhail sidhartha das claim sheena bora indrani mukerjea activities sheena bora murder myatery
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy