নির্বাচনী ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছিল নাগরিকত্ব, ডি ভোটার, এনআরসি প্রসঙ্গ। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না থাকায় কোনও রাজনৈতিক দলই ওই সব বিষয়গুলি ভোটের প্রচারের অংশ করেনি। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন তাতে উদ্বিগ্ন। রাজ্যের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ মানুষও। নাগরিক সভায় সে সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির অভিমত জানতে চাইলেন তাঁরা।
কয়েক দিন ধরেই মনোনয়ন পত্র পেশ করে বড়-ছোট সব দল, এমনকী নির্দল প্রতিদ্বন্দ্বীরাও বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মতামত জানান। তাঁদের নির্বাচনী প্রচারের মূল বক্তব্য কী হবে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেন সবাই। উন্নয়ন, দুর্নীতি, রাস্তাঘাট-সহ অনেক বিষয় তাঁরা তুলে আনেন। কিন্তু নাগরিকত্বের কথা মুখে আনেননি কেউ। মনোনয়ন পর্বের সময়ই জেলে থেকে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৫ বছরের ডি ভোটার বুলু শব্দকর। কোনও প্রার্থী বা তাঁদের দল কোনও কথাই তা নিয়ে কিছু বললেন না। এনআরসি অসমের বাঙালিদের অনেককে রাষ্ট্রহীন করতে চলেছে, এমন আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে অনেক দিন। ভোটের ময়দানের প্রচারে কিন্তু সে সব গুরুত্ব পায়নি।
সে সব বিষয়ই খুঁচিয়ে তুলল বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। বঙ্গভবনে নাগরিক সভা ডেকে উপস্থিত জনতার মতামত জানতে চাইলেন তাঁরা। দীপক ভট্টাচার্য, জয়দীপ বিশ্বাস, দীনেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস, সঞ্জীব দেব লস্কর, নীলাদ্রী রায়ের মতো বক্তারা রাজনৈতিক দলগুলির নীরবতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন— ‘অসমের বাঙালিদের রাষ্ট্রহীন করার লক্ষ্যে অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা পরিকল্পিত ভাবে এগোচ্ছে। এনআরসি-র নামে একাংশকে বিতাড়নের ব্যবস্থা পাকা করেই নিয়েছে। এর পরই শুরু হবে বাকিদের উপর মানসিক উৎপীড়ন। ভূমিপুত্রের সংজ্ঞায় বাঙালিদের বাদ দিয়েই শুরু হবে সংরক্ষণ আন্দোলন। ভূমিপুত্রদের জন্য ১০০ শতাংশ সংরক্ষণ চেয়ে বঙ্গভাষীদের পিষে মারা হবে।’ তাই অসমের বঙ্গভাষীদের জোটবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান বরাক বঙ্গের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতীশ ভট্টাচার্য। বরাক বঙ্গের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গৌতমপ্রসাদ দত্ত বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলিকে তাঁদের ইস্তেহারে নাগরিকত্ব ও ডি ভোটারের মতো বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে।’’
ভোট-গণনার তারিখ বদলের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে গণস্বাক্ষর সংবলিত স্মারকপত্র পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রকাশিত সূচি অনুসারে অসমে সব আসনে ভোটগণনা হবে ১৯ মে। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘১৯৬১ সালে ১৯ মে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১১ তরুণ-তরুণী প্রাণ দিয়েছিলেন। দিনটি এই অঞ্চলে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়।’’ বরাক বঙ্গের পক্ষ থেকে অবশ্য আগেও এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। জেলাশাসকের মাধ্যমে স্মারকপত্র পাঠানো হয়েছিল কমিশনের কাছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি। তাই এ বার গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে স্মারকলিপি পাঠানো হবে বলে জেলা সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী জানিয়েছেন।
বরাক বঙ্গের নাগরিক সভার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস, বিজেপি পরে নাগরিকত্ব নিয়ে উদাসীনতার অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রদেশ কংগ্রেস মুখপাত্র দীপন দেওয়ানজি বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। উদ্বাস্তুদের নাগরিক মর্যাদা দিতে রাজ্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রকে তা বিবেচনার জন্য বহু আগে পাঠিয়েও দেওয়া হয়। এ বার বিল আনার দায়িত্ব বিজেপি-র। তারা রাজনৈতিক স্বার্থে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখেছে।’’ অগপ-কে বাঙালিবিদ্বেষী হিসেবে উল্লেখ করে দীপনবাবু অগপ-বিজেপি জোট নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বিশেষ করে অগপকে নাগরিকত্ব নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে আর্জি জানান। বিজেপির রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজদীপ রায়ের পাল্টা দাবি, বিদেশি প্রসঙ্গে অগপ এখন অনেকটাই নরম। তাঁরা এখন বিজেপির সুরে কথা বলছেন। একে গেরুয়াবাহিনীর কৃতিত্ব বলে দাবি করেন তিনি। রাজদীপবাবু বলেন, ‘‘১৯৭১ সালের পর আসা হিন্দু বাঙালিদের কথা ভেবে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তার দরুন এখন আর কাউকে বিতাড়ন করা হবে না। আগামী দিনে বিল এনে সকলের নাগরিকত্বও সুনিশ্চিত করা হবে।’’ বিজেপি সরকারের বিজ্ঞপ্তি জারির পরও কেন বুলু শব্দকরকে জেলে থেকে প্রাণ হারাতে হল, কংগ্রেস কেন্দ্রের সরকারে থাকা অবস্থায় এই বিষয়টির সমাধান করলেন না, ভোটের মুখে এ সব প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছে বরাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy