Advertisement
E-Paper

সিপাইরা বলে, বুলেটে নাম লেখা থাকে! সীমান্তের ও পারের গোলায় হয়তো নাম লেখা ছিল ওই একরত্তির

মুহুর্মুহু গোলা এসে পড়ছে আশপাশে, মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে আরও প্রায় আড়াই ঘণ্টা কাটানোর পরে বারুদ শান্ত হল। এর পর ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও মেয়েটি কোনও কথা বলেনি।

স্যমন্তক ঘোষ, জম্মু

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ১৮:৪৮
Sound of uneasy silence in Jammu & Kashmir after ceasefire between India & Pakistan

বাবার কোলে... সোমবার দুপুরে জম্মুর রাস্তায়। ছবি: রয়টার্স।

‘শেল’ নয়, অনেক দিন পর ঘুম ভাঙল বাবার ফোনে। আসলে অনেক দিন পরে ঘুমোলাম। বালিশের পাশে ফোনের ‘ভাইব্রেশন’ যে খুব ভাল লাগছিল তা নয়! তবু বাবার ফোন তো! কথোপকথন অবশ্য আনন্দের নয়— ‘‘আবার বর্ডারে গিয়েছিলি? লেখা দেখলাম!’’

অন্য এক বাবার কথা লিখতে ইচ্ছে করছে। ১৫ বছর ধরে ‘ডিফেন্স বিট’ করা সাংবাদিক যোগেশ দীর্ঘদিনের বন্ধু। ৭ তারিখের ঘটনার পরেই মেসেজ এসেছিল, ‘‘জম্মু আসবি জানি। কখন কোথায় জানাস। সঙ্গে আছি।’’ টানটান পেশাদার যোগেশের সঙ্গে এর পরে কথা হয়েছে প্রতি ঘণ্টায়। কিন্তু দেখা হয়নি। দেখা হল সংঘর্ষবিরতির দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায়। জম্মুর হোটেলের ঘরে। এটা-সেটা কথা। কিছু টিপ্পনী। কিছু মজা। কিছু ভয়ের আদানপ্রদান হতে হতেই ফোন বাজছিল যোগেশের। তার আট বছরের কন্যা নাগাড়ে ফোন করে যাচ্ছে। হোয়াটস্‌অ্যাপ অডিয়ো কল। হোয়াটস্‌অ্যাপ ভিডিয়ো কল। ফেসটাইম কল। যোগেশ ধরছে বার বার। আর মেয়েকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করছে, ‘‘আজ কিছু হবে না, এটা তুমি তো জানো। বাবা বলেছে না!’’ বলে ফোন রাখছে। মুহূর্তের মধ্যে আবার মেয়ের ফোন আসছে।

বছর কয়েক আগে জম্মুতে দেখা হয়েছিল যোগেশের মেয়ের সঙ্গে। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ নামিয়ে পার্কে খেলতে যাওয়ার উৎপাত। বাড়িতে ‘আঙ্কল’ এসেছে। তাই রাতে পিৎজ়া খেতে যেতেই হবে। সেই মেয়ে ৭ তারিখের পর বাড়ি ছেড়ে আর বেরোয়নি। আকাশে গোলা দেখলে, শহরে সাইরেন বাজলে, ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে গেলে ক্রমাগত বাবাকে ফোন করে যাচ্ছে। যোগেশ মেয়েকে বুঝিয়েছে, এখন ‘সিজ় ফায়ার’। যুদ্ধবিরতি। আর গোলা উড়ে আসবে না। অন্ধকার হবে না। সাইরেন বাজবে না। কিন্তু সূর্য ডুবলেই আতঙ্ক গ্রাস করছে আট বছরের মেয়েকে।

আতঙ্কে স্থবির হয়ে আছে অন্য একটি মেয়ে। তার বয়স ছয়। নাম বলতে চাই না। নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি। ৮ তারিখ ভোরে এককাপড়ে জম্মু শহরের কাছে মাসির বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সকলেই। যে দিন সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা হল, বাবা-মায়ের হাত ধরে বিকেলবেলায় বাড়ি ফিরেছিল সে। বাড়িতে ঢুকেই গুছিয়ে নিয়েছিল পুতুল, গাড়ি, বইখাতা— শৈশব যাপনের যাবতীয় সরঞ্জাম। বাবা, মা, দাদুও নিশ্চিন্ত ছিলেন। সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করেছে সরকার! বাড়ি তো ফেরাই যায়!

সে এক ভয়ঙ্কর ‘নিশ্চিন্তি’। সন্ধে ৭টার পরে সে দিন ‘শেলিং’ শুরু হল। থামল রাত ১২টায়। গোটা বাড়িকে একটা ঘরে নিয়ে এলেন গৃহকর্তা। কেন কে জানে তাঁর ধারণা হয়েছিল, বাড়িতে সেটিই সবচেয়ে নিরাপদ ঘর। বাবা, মা, দাদু গোটা রাত বুকের মধ্যে জাপটে রেখেছিল ছিল ছ’বছরের কন্যাকে। ভোররাতে আবার ‘শেলিং’।

সিপাইরা বলে, বুলেটে নাম লেখা থাকে। সীমান্তের ও পারের ‘শেলে’ হয়তো নাম লেখা ছিল একরত্তি ওই মেয়ের। গোলা এসে পড়ল ওই বাড়িতেই। গোটা বাড়ি ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। স্‌প্লিন্টার ঢুকল সর্বত্র। পুতুল, খেলনাগাড়ি, রান্নাবাটি, জিয়াইজো কম্যান্ডো মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে গেল। ঘরের কাচ ভেঙে আহত হলেন বাবা, দাদু, মা। তাঁদের বুকের মধ্যে থাকা মেয়েও আহত হল। বেরোতে পারলেন না কেউ। মুহুর্মুহু গোলা এসে পড়ছে আশপাশে, মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে আরও প্রায় আড়াই ঘণ্টা কাটানোর পরে পরিবেশ যখন শান্ত হল, সকলে ফিরে এলেন আবার মাসির বাড়ি। তার পরে ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। মেয়েটি কোনও কথা বলেনি।

আবার অনর্গল কথা বলে চলেছে আর একটি মেয়ে। বয়স ৯। বাবা ভারতীয় সেনার ক্যাপ্টেন। মেয়েটি জানে, বাবা দেশের কাজ করতে গিয়েছে। আপাতত কিছু দিন কথা হবে না। কিন্তু তর সয় না! মেয়েটি জানে বাবার ‘পত্রকার’ বন্ধুও জম্মুতে। প্রতি দিন দু’বার, তিন বার, চার বার মেয়েটি ফোন করে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আঙ্কল তোমরা ভাল আছো তো?’’ কী করে উত্তর দিই যে, তার বাবার সঙ্গে আমারও কোনও কথা হচ্ছে না। আমি জানিও না, সে কোথায় আছে! প্রতি বার বলতে হয়, আমরা সকলে ভাল আছি। তুমিও ভাল থেকো। ভয় পেয়ো না।

৮ তারিখ মাঝরাতে রাজৌরীর শেল্টারে বসে আকাশে যখন একের পর এক লড়াই দেখছি, দিল্লি থেকে যে ড্রাইভার-দাদা এসেছেন এত দূর, তিনি মোবাইলে নিজের ছেলের ছবি খুলে রেখেছিলেন। ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধের’ ইত্যাবসরে এমন অনেক বাবা এবং সন্তানদের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে রাজৌরিতে দেখা সেই মায়ের কথাও, দু’চোখে জল নিয়ে সন্তানের হাত ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে যিনি কেবলই বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা দু’রাত ঘুমোতে পারেনি। এক টুকরো খাবারও মুখে তোলেনি। গোলার আওয়াজ শুনলেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাড়ি গেলে হয়তো আবার একটা বাড়ি হবে। আগে ছেলেটাকে তো বাঁচাই।’’

অনেক দিন পর ঘুমোলাম গত রাতে। শেলের আওয়াজ নেই। নেই গুলির আওয়াজ। ‘ব্ল্যাক আউটের’ সাইরেন নেই। যোগেশকে ছেড়ে আসা ইস্তক ভয়ঙ্কর ঘুমিয়েছি। কখন যে ভোর হয়ে হোটেলের কাচ বেয়ে, খাট বেয়ে রোদ ছেয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি। এমন এক ভোর-ঘুমে মোবাইলের ‘ভাইব্রেশন’ ভাল লাগছিল না। কিন্তু ওই যে বাবার ফোন! ধরলাম— ‘‘আবার বর্ডারে গিয়েছিলি! লেখা দেখলাম। তুই ফিরবি না? ঘুমোতে পারছি না যে!’’

বুঝলাম, সংঘর্ষবিরতির দ্বিতীয় রাতে আমি ঘুমোলেও বাবা ঘুমোয়নি।

(লেখক ডয়চে ভেলের সাংবাদিক)

India-Pakistan Ceasefire India-Pakistan relation India-Pakistan Conflicts Kashmir Terror Attack Pahalgam Terror Attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy