Advertisement
E-Paper

ভেলনেশ্বর

সাগরজলে শেষ বিকেলের রোদ চলকাচ্ছিল। এখানে অনেকটা সময় জুড়ে বিকেলের স্থায়িত্ব। ওই সময় সৈকতে ভিড়টাও কিঞ্চিৎ বেশি। পর্যটকরাও তুমুল হুটোপাটির আনন্দে মেতেছেন ঢেউয়ের সঙ্গে। দূরে সাগরের গহন অন্দরে উত্তাল ঢেউয়ের তালে জেলেদের ডিঙি কখনও দৃষ্টির সামনে হারিয়ে গিয়েই পরমুহূর্তে আবার ভেসে ওঠা। একটা ঢেউয়ের মাথা টপকে ধেয়ে আসছে নতুন ঢেউ।

লিখছেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩

২২ মার্চ ২০১৬
রাত ৮টা ৫০
এমটিডিসি হলিডে রিসর্ট
গণপতিপুলে-৪১৫৬১৫

সাগরজলে শেষ বিকেলের রোদ চলকাচ্ছিল। এখানে অনেকটা সময় জুড়ে বিকেলের স্থায়িত্ব। ওই সময় সৈকতে ভিড়টাও কিঞ্চিৎ বেশি। পর্যটকরাও তুমুল হুটোপাটির আনন্দে মেতেছেন ঢেউয়ের সঙ্গে। দূরে সাগরের গহন অন্দরে উত্তাল ঢেউয়ের তালে জেলেদের ডিঙি কখনও দৃষ্টির সামনে হারিয়ে গিয়েই পরমুহূর্তে আবার ভেসে ওঠা। একটা ঢেউয়ের মাথা টপকে ধেয়ে আসছে নতুন ঢেউ। প্রসারিত দৃষ্টির নেপথ্যে দূরের প্রবল উদ্দামতা দেখে পারে দাঁড়িয়ে শিহরিত হই। ওদিকে আকাশময় ফালি ফালি ছেঁড়া রোদ্দুর। খানিক পরই ছেয়ে যাবে বিকেলের টুংটাং। পায়ের পাতায় মিশে যাচ্ছে সাগরছোঁয়া সুখ।

মরাঠি শব্দ ‘পুলে’ অর্থ বেলাভূমি। শতাব্দীপ্রাচীন স্বয়ম্ভু দেবতা গণপতি থেকেই এসেছে গণপতিপুলে স্থানটির নাম। কোঙ্কন উপকূলের চেনা লাবণ্যটুকু নিয়েই মনোহর রূপে এলিয়ে আছে গণপতিপুলে গ্রামটি। নারকেল বনের প্রতিটি পাতা থেকে পাতায় শিহরন খেলে যায় উপকূলবর্তী সমুদ্র হাওয়ার কোলাহল। সাগরের কাছটিতে সকাল-বিকেল যত বারই আসছি, আপাদমস্তক ভাললাগার ঘ্রাণ সেখানে উথলে উঠছে ঢেউয়ের বাচালতায়। দুষ্টুমি ঢেউয়ের সহজাত। আমাদের মতো সমুদ্রবিলাসী পর্যটকদের প্রশ্রয় পেয়ে ওরা আরও বাচাল। আমরাও গা ছেড়ে দিই আমুদেপনা আর বাঁধনছাড়া আহ্লাদ নিয়ে। গণপতিপুলের মোক্ষম মরসুম হল অক্টোবর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই সময় জলবায়ুও সুন্দর। এর পরে গরম আর বর্ষা। তবে গরমের দিনগুলোয় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়লেও, রাতের দিকে তাপমাত্রা হ্রাস পায় অনেকটাই। স্থানীয় গ্রামবাসীদের জীবিকা মূলত খেতিবারি। এখানকার জমি ধান ও নারকেল চাষের উপযোগী। এই গ্রামটির সমগ্র দেখভালের দায়িত্বে এখানকার গ্রামপঞ্চায়েত। শুধুমাত্র মন্দির দর্শনই নয়, গণপতিপুলের এমটিডিসি-গুলিতে রিসর্টের কোঙ্কনি কটেজ বা অন্য ঘরগুলিতে দু’তিন দিন থাকলেও আরামে কেটে যাবে অবসর সময়ের অনেকখানি। সমস্ত চত্বরটা খুব যত্ন আর তদারকিতে পরিচর্যা করা। এই অঞ্চলে আরও অনেক রিসর্ট, হোটেল, লজ রয়েছে। মন্দির ট্রাস্টির একটি অতিথিনিবাসও আছে।

কালই চলে যাব অন্য এক সৈকতভূমে। সেখানেও একটা দিন ও রাত কাটাব। আপাতত সাগরের জলপাহারায় বয়ে যাচ্ছে গণপতিপুলের শান্ত নিরালা সাগরকথা। নারকেলগাছের বিজন ছায়ায় কোঙ্কন সাগরতটের আবহমান চেনা সেই ছবি। সফর ও প্রকৃতিপাঠ সেখানে সমার্থক হয়ে উঠেছে।

২৩ মার্চ, দুপুর ২টো ১০

এমটিডিসি হলিডে রিসর্ট

ভেলনেশ্বর, তালুক- গুহাগর

জেলা-রত্নগিরি,মহারাষ্ট্র

লাবণ্যমাখা অফুরান সৈকত। এ লাবণ্য একান্তই মৌলিক ও অকৃত্রিম। এই ভেলনেশ্বর সৈকতের সফেদ বালুকাবেলা, নির্জনতা, সার দেওয়া নারকেলবীথি, নাতিদীর্ঘ পাহাড়ি টিলা-ঘেরা নির্ভেজাল অবয়ব একে অনন্য করেছে। পাহাড়ি টিলার দুই ধারেই নীল সাগরের অতল রূপ। সৈকতের ধার বরাবর নুইয়ে আছে পাতার ঝালর শোভিত নারকেলগাছের ছায়া। শান্ত সমাহিত এক কোঙ্কনি গ্রাম ভেলনেশ্বর। হাওয়ায় সেই চেনা লোনা গন্ধ। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো যেমন হয় আর কী! প্রাতরাশ শেষ করেই গণপতিপুলেকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম ভেলনেশ্বর সৈকতের উদ্দেশে। গণপতিপুলে থেকে ভেলনেশ্বরের দূরত্ব মাত্র ৩৮.৯ কিমি। একবার ফেরিতে, বাকিটা রাজ্য সড়ক-৪ ধরে গাড়িতে। সময় লাগে কমবেশি দেড়ঘণ্টা মতো। গণপতিপুলে থেকে সৈকত ঘেঁষা পথ ধরে এসেছি। পথে মালগুন্দ সৈকতকে বাঁয়ে রেখে উন্ডি গ্রাম, কাচারে গ্রাম। তার পরেই যাত্রাপথের বাঁদিক জুড়ে একে একে নানদিভি সৈকত, কুনবিওয়ারি সৈকত ইত্যাদি অচেনা সব সৈকত পেরিয়ে কিছুটা চলার পর জয়গড় জেটি। এখানে জলপথে গাড়ি-সমেত বার্জ-এ সাগর পেরোতে হবে। ওপারে তাভসন জেটি। ভৌগোলিক মানচিত্রে এই অঞ্চলটিতে আরবসাগর, উপকূল-কিনারার খানিক ভিতরে চলে এসেছে। চার চাকা-তিন চাকা-দু’চাকা মিলিয়ে বার্জ-এ ৮-১০টি বা তার কিছু বেশি গাড়ি। যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগ স্কুল ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, অফিসযাত্রী এবং বিভিন্ন পেশার নারী-পুরুষ। জলযানের খোলা পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করি। ফেরিঘাটের দু’পাশেই সাগরজলে মৎস্য বাণিজ্যবাহী প্রচুর ট্রলার রয়েছে। তাদের প্রতিটির মাথায় নানান রঙের নিশান পতপত করে উড়ছে। সাইরেনের বিকট ভোঁ বাজিয়ে জলযানের যাত্রা শুরু হল। মাত্র আড়াই কিমির জলপথ ভ্রমণ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে না করতেই ফুরিয়ে যায়। অন্য পারে তাভসল ফেরিঘাটে পৌঁছে লোহার শিকল বেঁধে জলযানটি ভেড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।

তাভসল ফেরিঘাট থেকে বাঁ দিকের রাজ্য সড়ক-৪ ধরে আবার পথ চলা। এদিকেও কয়েকটি একাকী সৈকত বিছিয়ে আছে। তাভসল সৈকত, রোহিলে সৈকত, হেদাভি সৈকত। হেদাভিতে প্রাচীন লক্ষ্মীগণেশ মন্দিরটির গঠন খুবই সুন্দর। মন্দিরের দশভুজ তিন ফুট মূর্তি। স্থানীয় মতে, এই মূর্তিটি কাশ্মীর থেকে নিয়ে এসে এখানকার মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিবছর মাঘ মাসে দেবতার জন্মোৎসব পালিত হয়। পৌঁছে যাই আদিগন্ত সমুদ্রের নীল প্রেক্ষাপটে ভেলনেশ্বর নামের শান্ত নিরালা কোঙ্কনি গ্রামটিতে। বেশ কিছু দোকানপাট, বাড়িঘর, শিবমন্দির, মাঝারি মানের রেস্তোরাঁ, কয়েকটি হোটেল নিয়ে আরবসাগর ও শাস্ত্রী নদীর মোহনাকে নাগালে রেখে ভেলনেশ্বর গ্রামটির অবস্থান। সমতল ছেড়ে অনুচ্চ পাহাড়ি টিলার চূড়ায় মহারাষ্ট্র সরকারের হলিডে রিসর্ট। চড়াই পথে টিলা টপকে পৌঁছে যাই এমটিডিসি-র আবাসের দোরগোড়ায়। এক্কেবারে হিলটপে। নীচে পড়ে থাকে সাগরসৈকত ও ভেলনেশ্বর গ্রামের সহজ চিত্রাবলি।

ঘরগোছানো বাঙালির মতো, সপ্তাহতিনেক আগেই মহারাষ্ট্র পর্যটন দফতরের এই কোঙ্কনি কটেজটিতে থাকার অগ্রিম বন্দোবস্ত করা ছিল। এখানে ছুটিছাটায় কিঞ্চিৎ ভিড় হয়। ভিড়ের বেশিটাই কাছেপিঠের মুম্বই বা পুণে থেকে আসা পর্যটক। আসলে ভ্রমণ মানচিত্রে এই স্বল্পপরিচিত সৈকতটির তেমন কোনও পরিচিতি নেই। তাই খুব বেশি পর্যটক এখানে আসেন খুব কম। রিসেপশনে কাউকে না দেখে অনেক ডাকাডাকি করলাম। তাতেও কারও দেখা নেই। লাগেজটাগেজ নিয়ে অপেক্ষায় থাকি বেশ কিছুক্ষণ। ড্রাইভার পরে ভেতরের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে দফতরের কার্যনির্বাহী এক কর্মীকে ডেকে আনে। তিনি রেজিস্টার খুলে নথিপত্র লেখার পর নির্ধারিত ১০৪ নম্বর কটেজটির চাবি হাতে পেলাম। ছোট্ট পাহাড়ি টিলার শীর্ষে খাঁজে খাঁজে ছড়ানো এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আবাস। প্রতিটি ঘরই লালরঙা ও অষ্টভুজাকৃতি। দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে দরজা খুলেই শীতল আশ্বাস। লাগোয়া আধুনিক সুবিধাযুক্ত স্নানাগার। ঘরের একপাশে সাজঘর। অন্য দরজা খুললেই সাগরমুখী এক ফালি চওড়া বারান্দা। ঘরের ভারী পর্দা সরালে কাচের জানালার ওপাশে ঘাসের লন, রঙিন লোহার বেঞ্চ, দোলনা, ফলের বাগিচা। এবং সব কিছু ছাড়িয়ে অতল সাগরের মধুর হাতছানি। ঘরে কাঠের সুন্দর সব আসবাবপত্র থাকলেও, খুব অবাক হলাম মার্বেল পাথরের খাট দেখে। ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে মার্বেল পাথরের খাট। দু’পাশে ওই একই কালো মার্বেলের বেডসাইড টেবিল খোদাই করা। পাথরের খোদাই খাট জন্মে দেখিনি। তাই আশ্চর্য রকমেরর এক উপলব্ধি হচ্ছিল। মার্বেলের খাটে পরিপাটি করে বিছানা পাতা।

মধ্যাহ্নে রিসর্টের খাওয়ার ঘরে গিয়ে কোঙ্কনি থালি নেওয়া হল। সঙ্গে ডবল ডিমের অমলেট। কোঙ্কনি থালিতে ছিল ছোট একবাটি ভাত, দুটি চাপাটি, অড়হর ডাল, দু’বাটি ভাজ্জি, ছোট বাটিতে কোকম শরবত, ছাস, আচার ও সেঁকা পাঁপড়। বাইরে তখন রোদের যথেষ্ট আঁচ। আমাদের ঘর থেকে খাবার ঘরটা খানিক দূরে। তাই খাওয়ার পরে ওই রোদের হলকা গায়ে মেখে ঘরে ফিরে, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডায়েরি লিখতে বসি। আর কিছু তো করার নেই। মোবাইল টাওয়ারও এই আছে, এই নেই।

২৩ মার্চ, রাত ৯টা ৫০

এমটিডিসি হলিডে রিসর্ট

ভেলনেশ্বর-৪১৫৭২৯

তুলকালাম করে দিচ্ছে আবেগজড়ানো পাতি এই ভাবুক মনখানা। কোথাও বেড়াতে এলেই এমনটা হয়। পাগলপারা মনটার ভিতর এমনটাই চলতে থাকে। চোখের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে ভেলনেশ্বরের প্রকৃতি। বিকেলের অসাধারণ রূপসুধা বেশ মনোগ্রাহী। দুপুরের প্রখর আঁচ একটু নিভু হতেই গাড়ি নিয়ে উতরাই পথে নেমে আসি। পাখির কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। দিগন্তবিস্তৃত গাঢ় নীলচে-সবুজ জলে অস্তমিত রাঙা আলোর বিচ্ছুরণ। দূর সমুদ্রে ভাসতে থাকা রংবেরঙের নৌকাগুলি ডুবন্ত বেলার সৌন্দর্যকে আরও মহার্ঘ করেছে। শান্ত সমুদ্র, উতল হাওয়া, নারকেলগাছের ডালের বাসায় ফিরতে থাকা পাখির ঝাঁক, কিংবা ডিঙিনৌকো নিয়ে ফিরে আসা জেলের দল—সব মিলিয়ে এক সুন্দর দৃশ্যপট ভেলনেশ্বরের চারপাশে। সৌম্যসুন্দর প্রকৃতির আলিঙ্গনে নিজেকে খানিক লীন করে নিতে ইচ্ছে জাগে। শাস্ত্রী নদীর উত্তরপানে, ভেলনেশ্বর গ্রামটিতে শতাব্দীপ্রাচীন পবিত্র শিবমন্দির আছে। লোকশ্রুতি : অনেক কাল আগে স্থানীয় এক জেলে সাগরে মাছ ধরতে যায়। সে নজর করে তার জালে এক মূর্তি আটকে আছে। মূর্তিটিকে জাল থেকে ছাড়িয়ে ফের জলে ছুঁড়ে দিতেই, মূর্তিটি আবার জালে জড়িয়ে যায়। এবার কিন্তু জেলে প্রচণ্ড চটে যায়। মূর্তিটি জাল থেকে ছাড়িয়ে সজোরে পারের একটি পাথরের ওপর ছুড়ে মারে। কিন্তু পরমুহূর্তেই জেলের চক্ষু চড়কগাছ। সে দেখে পাথরের আঘাতে মূর্তিটি থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এবার অনুতপ্ত জেলে মূর্তিটি সযত্নে তুলে এনে ভেলনেশ্বর গ্রামের দোচালা এক মন্দিরে স্থাপন করে। প্রতিবছর মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে ভেলনেশ্বর। দূরদূরান্ত থেকে আসেন ভক্তের দল। এই কালভৈরব মন্দিরে আছে শ্রীবিষ্ণু, শ্রীগণেশ, শ্রীকালভৈরব ও শ্রীমহাদেবের মূর্তি। মন্দিরের সামনে আছে এক প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ। আছে দু’একটি ঝাঁপবন্ধ ঝুপড়ি দোকান। একপাশে চা-কফি-ঠান্ডা পানীয়ের দোকান। কালভৈরব মন্দিরের গা ঘেঁষে সৈকতে যাবার পথ।

মন্দিরের পেছনেই সৈকত। সেখানে আছে দুটি সাধারণ মানের নিরামিষ রেস্তোরাঁ। গাড়ি পার্কিঙের জন্য ফাঁকা জায়গা আছে। আছে নারকেল গাছের জঙ্গল ও সিমেন্ট বাঁধানো কয়েকটি বসার জায়গা। কয়েক ধাপ পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে বালিয়াড়ির বুকে। এখানে টানা মসৃণ সফেদ বালিয়াড়ি। যেখানে সাগরের ঢেউ ভাঙে ও ফিরে যায়। এই স্থান পর্যটকদের সমুদ্রস্নান ও রৌদ্রস্নান তথা সানবাথের জন্য উপযোগী। এই সুন্দর বিকেলে বিস্তীর্ণ সৈকতে আমরা ছাড়া রয়েছে আর এক দম্পতি। আমরা পরস্পরের ছবি তুলে দিই। সেই সুযোগে খানিক পরিচয়ও হয়ে যায় ওই তরুণ মরাঠি দম্পতির সঙ্গে। নারকেলগাছে ছাওয়া চমৎকার সৈকত। ফেনায়িত ঢেউগুলি নিজেদের খেলায় মত্ত। হালকা লয়ে গড়িয়ে এসে গোড়ালি পর্যন্ত ভিজিয়ে, ফিরে যাওয়ার মুহূর্তেই অন্য একপ্রস্থ ঢেউয়ের জটলা জুটে যাচ্ছে। আবার ফিরে যাচ্ছে নিজস্ব ছন্দে অনুপম মৃদুতায়। ঠিক এমন মুহূর্তগুলোই তো ভাললাগার জন্ম দেয়। খানিক দূর পর্যন্ত চলে গেছে মিহি বালুতট। অর্ধচন্দ্রাকার সৈকত। দক্ষিণে জেলেদের ঘরবাড়ি। উত্তর প্রান্তে কিছু প্রাইভেট বাংলো। আসার সময় বিচ রোডে চোখে পড়েছিল কিনারা বিচ হাউস, অতিথি রিসর্ট ইত্যাদি কয়েকটি থাকার আস্তানা। বর্ষা শেষ হতেই যদি এখানে আসা যায় তবে সুন্দর সাজানো প্রকৃতি আপনাকে আরও নিবিড় ভাবে স্বাগত জানাবে। সৈকত ধরে মনমৌজি হেঁটে চলেছি। এই পড়ন্ত বিকেলে সাগরের ঢেউ ভাঙার মৃদু সঙ্গীত ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই এ তল্লাটে।

একটু পরেই শুরু হয়ে গেল সাগরের সঙ্গে আকাশখানার মিলমিশ যেখানে, ঠিক সেখানটাতেই অর্কদেবের লাল-কমলা রঙের হোরিখেলা। তারও তো ঘরে ফেরার সময় হল। একটু রংবাহারি খেল তো রোজ সে দেখায়ই। তার ওপর বাংলা ক্যালেন্ডারে আজই দোলপূর্ণিমা। ক্যামেরায় ভরে নিচ্ছি অর্কদেবের ঘরে ফেরার দৃশ্যাবলি। ওদিকে নারকেলগাছের মাথায় কখন থেকে রুপোলি গোলপানা চাঁদটাও ফুটে আছে। রঙিন এক টুকরো সূর্যাস্তকে ক্যামেরার ভরতে না ভরতেই দেখি, চাঁদটাও তখন আকাশ মাতাচ্ছে।

ঝুপ্পুস অন্ধকারে ক্রমশ ছেয়ে যায় চারপাশ। আমার সঙ্গীটি নারকেলবীথির মাথায় রুপোর থালার মতো দোলপূর্ণিমার চাঁদের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কখনও নিজের মোবাইল ক্যামেরা, কখনও সাধের নিক্কন ক্যামেরাকে আকাশপানে উঁচিয়ে একের পর এক ছবি তুলে যেতে থাকে। গাড়ি রাখার জায়গার কাছে এক রেস্তোরাঁ থেকে দুটো চেয়ার চেয়ে এনে জুত করে বসে চিপসের প্যাকেট থেকে আলতো করে একেকটা চিপস মুখে তুলি, আর আনমনে চেয়ে থাকি কালো সাগরের দিকে। বস্তুত রাতের নিজস্ব রূপ দেখতেই চেয়ার টেনে বসি। এ রূপ ভেলনেশ্বরের একান্ত নিজস্ব। মহানগরের নাটুকে ক্লান্ত মননে এই সন্ধ্যাটুকু বিবশ করে দেয়।

সৈকত লাগোয়া সাধারণ মানের নিরামিষ রেস্তোরাঁয় রাতের আহারের অর্ডার দেওয়া ছিল আগেই। ও দিকে আবার হিলটপে রিসর্টে ফিরতে হবে। এই দিকটা এখন পুরোপুরি সুনসান। চেয়ারগুলো ফিরিয়ে নিয়ে ভিতরে গিয়ে বসি। রান্নাঘরে দেখি, পুরো পরিবারটাই আমাদের জন্য খাওয়ার তোড়জোড় করছেন। সবাই রান্নার কাজে ব্যস্ত। মালিক চাপাটি সেঁকছেন। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর গিন্নি চাপাটি বেলে দিচ্ছেন। কানে দুল ও কায়দার ছাঁট দেওয়া রং করা সোনালি চুলের মালিকের তরুণ ছেলেটি অন্য গ্যাস চুলায় নিজে হাতে আলু-জিরে-মেথির একটা শুকনো ভাজি বানিয়ে ফেলছে ততক্ষণে। চাপাটি সেঁকা শেষ করেই রেস্তোরাঁ মালিক তুর ডালে সম্বর দিতে থাকলেন। ও দিকে মালিকের স্কুলপড়ুয়া পৃথুলা মেয়েটিও বাবার সঙ্গে পুরোদস্তুর রান্নার কাজে হাত লাগানো থেকে শুরু করে মিক্সিতে দইয়ের ছাস বানিয়ে গ্লাসে ঢেলে দেওয়া ইত্যাদি সবই করছিল। ওদের পুরো পরিবারের এমন ব্যস্ততা ও রেঁধেবেড়ে খাওয়ানোর কথা ডায়েরিতে লিখে রাখি।

রাত দশটা বেজে গেছে ঘড়িতে। সেই স্কুলপড়ুয়া মেয়েটি এ বার স্কুলখাতার উল্টো পিঠে খাবার-দাবারের হিসেব কষতে বসে। দোকান মালিকের কাছে কথায় কথায় জেনে নিই, এই গ্রামে স্মার্ত ঐতিহ্য পরম্পরাবাহী। গ্রামবাসীদের মধ্যে আছেন সাভারকর, তুলপুলে, গোভান্দে, ঘাগ, গোখেল, গাডগিল, ভেলঙ্গর ইত্যাদি পদবির পরিবার। এঁরা সকলেই হিন্দু এবং গণেশ, বিষ্ণু, সূর্য, দুর্গামাতা, শিবের উপাসক। দোকানি পরিবারটি হিন্দিতে তেমন পোক্ত নয়। নিজস্ব দেশজ মরাঠি ড্রাইভার তখন আমাদের মধ্যে ইন্টারপ্রেটারের ভূমিকায়।

রাতে রিসর্টে ফিরেই ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে বসি। ঘরের ভেতর থেকেও সমুদ্রের গর্জন টের পাচ্ছি। দোলপূর্ণিমার ভরাট চাঁদে সাগরে এখন জোয়ারের টান। রাত যত গহিন হচ্ছে, সাগরজলে জোয়ারের দৌরাত্ম্য ততই। উথালপাতাল ঢেউ কূলে এসে আছড়ে পড়ছে। উপকূলবর্তী গাছের সারির মাথায় লোনা হাওয়ার দাপাদাপি বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সমস্ত চরাচর নিশ্চিন্ত- নিরালা-নির্জন। চাঁদের আলো ঠিকরানো ঢেউয়ের মাথা ঝিকমিক করে চমকে ওঠে। দূরে মায়াবী আলো যেন কখনও ঝলসে উঠেই মিলিয়ে যায়। আর ভেলনেশ্বরের সৈকত শোনায় ঢেউ ভাঙার গল্প...

Velneshwar Coast Maharashtra Madhuchhanda Mitra Ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy