রবিবারের সন্ধ্যায় পটনার গান্ধী ময়দানের সামনে যদি ক্যুইজ়ের আসর বসে, আর সেখানে যদি প্রশ্ন করা হত, বিহারে শেষ কবে কংগ্রেসের কেউ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তা হলে দশ জনের মধ্যে ন’জনই উত্তর দিতে পারতেন কি না সন্দেহ। হয়তো শেষ কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্রের নাম কেউ কেউ বলতে পারতেন। কিন্তু কত বছর আগে জগন্নাথ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন?
কঠিন প্রশ্ন। কারণ, সে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। ১৯৯০ সাল। রাহুল গান্ধী তখন মাত্র ২০ বছর বয়সি। সবে ভোটার হয়েছেন। রাজনীতি থেকে অনেক দূরে।
পঁয়ত্রিশ বছর পরে সেই রাহুল এখন বিহারে ভোটার অধিকার যাত্রা করছেন। ঘোষিত লক্ষ্য অবশ্যই নির্বাচন কমিশন ও বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ। কিন্তু আসল লক্ষ্য, বিহারে কংগ্রেসের নিজস্ব ভোটের পুনরুদ্ধার।
এই গান্ধী ময়দান থেকেই সোমবার রাহুলের ভোটার অধিকার যাত্রার সমাপ্তি অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। প্রথমে গান্ধী ময়দান থেকে রাহুল, তেজস্বী যাদবরা অম্বেডকর পার্কে ভীমরাও অম্বেডকরের মূর্তি পর্যন্ত পদযাত্রা করবেন। তার পরে সেখানে জনসভা হবে। তৃণমূল থেকে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, শরদ পওয়ারের এনসিপির মতো ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সব শরিক দলের নেতা-নেত্রীরাও হাজির থাকবেন। রবিবার কংগ্রেসের নেতারা তার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখতে গান্ধী ময়দানে হাজির হয়েছিলেন।
গত ১৬ দিন ধরে বিহারের ভোটার অধিকার যাত্রায় রাহুলের সঙ্গে তেজস্বী ছিলেন। তিনি রাহুলের সামনে নিজেকে বিরোধী জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবেও ঘোষণা করে ফেলেছেন। কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, বিহারে অক্টোবর-নভেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী জোট ক্ষমতায় এলে তেজস্বী যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ভোটে কংগ্রেসের আসল পরীক্ষা হল রাহুলের ভোটার অধিকার যাত্রা থেকে ফায়দা তোলা।
১৭ অগস্ট সাসারাম থেকে এই যাত্রা শুরু হয়। সাসারামের দলিত ভোটব্যাঙ্ক মিথিলাঞ্চলের ব্রাহ্মণ ভোটারদের কাছে কংগ্রেস পৌঁছনোর চেষ্টা করেছে। বিহারে ভোটার তালিকায় সংশোধনের ফলে গরিব দলিত, মুসলিম, অনগ্রসরদের নামই ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে কংগ্রেস জাতপাতের অঙ্ক কষছে। এক সময়ে কংগ্রেসে জগন্নাথ মিশ্রের মতো ব্রাহ্মণ নেতারা ছিলেন। মীরা কুমারের মতো দলিত নেত্রী সাসারাম থেকে সাংসদ হয়েছেন। ওবিসি, মুসলিম ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতেই ছিল। তার পরে সেই ভোট লালুপ্রসাদ, নীতীশ কুমারদের ঝুলিতে চলে গিয়েছে। গত কুড়ি বছর ধরে বিহারে কংগ্রেসের ভোটের ভাগ ১০ শতাংশের নীচেই। গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বিহারের ২৪৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭০টিতে লড়েছিল, কিন্তু জিতেছিল মাত্র ১৯টিতে। কংগ্রেস এ বার আরজেডির নেতৃত্বে মহাগঠবন্ধনে যে সব আসনে জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সেখানে লড়তে চাইছে।
কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল মনে করাচ্ছেন, রাহুলের যাত্রা ১১০টি বিধানসভা কেন্দ্র ছুঁয়েছে। যে ২৫টি জেলার মধ্যে দিয়ে এই যাত্রা সাসারাম থেকে পটনায় পৌঁছেছে, এখন তা বিজেপি, জেডিইউ, চিরাগ পাসোয়ানের মতো এনডিএ-র দুর্গ বলে পরিচিত। কংগ্রেসের দাবি, গ্রামাঞ্চলে রাহুল, তেজস্বীর যাত্রায় বিপুল সাড়া মিলেছে। বিশেষ করে মহিলা ভোটাররা ভিড় জমিয়েছেন।
বিজেপি নেতারা অবশ্য বলছেন, বিধানসভা নির্বাচন হয় মানুষের সমস্যা নিয়ে। রাজনৈতিক দল তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ে। রাহুল সেখানে খেলার রেফারি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই লড়তে নেমে গিয়েছেন।
কংগ্রেস মনে করছে, জাতপাতের সমীকরণ মেনে, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে, নীতীশ কুমারের সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে বিহারে বিরোধীদের জোট যদি ভাল ফল করতে পারে, তা হলে লোকসভা ভোটে বিরোধীদের পালে যে হাওয়া উঠেছিল, তা আবার ফিরে আসবে। রাহুল অভিযোগ তুলছেন, লোকসভা ভোটে ভাল ফল করেও মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধীদের হার হয়েছে এই ‘ভোট চুরি’র কারণে। বিহারে সেই ‘ভোট চুরি’ তাঁরা আটকে দেবেন।
গান্ধী ময়দানের আসল প্রশ্ন হল, ‘ভোট চুরি’ আটকে কংগ্রেস নিজেদের চুরি যাওয়া ভোট উদ্ধার করতেপারবে তো!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)