বিমানবন্দরে আচমকা মোলাকাত হয়ে যাওয়ার পরে বিজেপির সাংসদ এবং ভোজপুরি অভিনেতা রবি কিসান তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘‘উনি ভক্ত মানুষ। ভোলেবাবার মতো! আমরা খোলা মনে ওঁর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করব।’’
অপেক্ষায় আদৌ ফল মিলবে কি না, ঠিক নেই। তবে ভোলেবাবাই বটে! জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। উদাসী চেহারা নিয়ে ভোটের মরসুমে ফি রোজ বিমানবন্দরে আসেন। নন্দী-ভৃঙ্গীর মতোই দুই অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে ওঠেন। জেলায় জেলায় প্রচার সেরে আবার একই রকম উদাসী চেহারা, শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরে যান।
এখানে একটু ভুল হল। আসলে ‘ঘর’ বলে কিছু নেই তাঁর। বিহার রাজনীতির সব চেয়ে প্রভাবশালী পরিবার তাঁকে ‘ত্যাজ্য’ ঘোষণা করে দিয়েছে ছ’মাস আগে। পারিবারিক নেতৃত্বের দল থেকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়ে ‘জনশক্তি জনতা দল’ নামে নতুন দল খুলেছেন। সেই দলের নামের সঙ্গে আবার চিরাগ পাসোয়ানদের লোক জনশক্তি পার্টিকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকে! চর্তুদিক থেকে কোণঠাসা হয়ে তেজপ্রতাপ যাদব এখন খুঁজে চলেছেন ‘জয়চাঁদ’দের! যাঁরা নাকি কলকাঠি নেড়ে তাঁর ঘর ভেঙে দিয়েছে।
বাবা লালুপ্রসাদ এবং মা রাবড়ী দেবী, দু’জনেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দিদি মিসা ভারতী সাংসদ। আর এক বোন রোহিনী আচার্যও রাজনীতিতে সক্রিয়। আর ভাই তেজস্বী যাদব এ বার বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। রাজনৈতিক ভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এত মুখে ঠাসা এক পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে তেজপ্রতাপের কি আর ফিরে আসা সম্ভব? বিহারের রাজনীতির অলিন্দে জনশ্রুতি আছে, নিজের রাস্তা নিষ্কণ্টক করতে তেজস্বীরও হাত ছিল দাদাকে ‘ত্যাজ্য’ করার সিদ্ধান্তে। ভোট-প্রচারের মাঝে এক দিন অচানক বিমানবন্দরে দাদাকে দেখে তেজস্বী একটা হাঁক পেড়ে দুষ্টু হাসি হাসছিলেন। ‘ভোলেবাবা’ তেজপ্রতাপ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েই ছিলেন। মুখে কথা সরেনি। বলে রাখা যাক, বিহারে তেজস্বীর গায়ে একটা ‘শাহজাদা’ ছাপ আছে, অদৃশ্য হলেও। তেজপ্রতাপ কিন্তু অনুগামী এবং আম আদমির কাছে ‘তেজু ভাইয়া’।
সমাজমাধ্যমে নানা ভিডিয়ো, একাধিক কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্কের জেরে গত মে মাসে কড়া বিবৃতি দিয়ে বড় ছেলেকে পরিবার ও দল থেকে বার করে দিয়েছিলেন লালুপ্রসাদ। তেজস্বী যাঁকে মাঝে মাঝে বলেন ‘লর্ড লালুপ্রসাদ’! তেজু ভাইয়া অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘ঘর থেকে বার করে দেওয়ার পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। পরে কী হবে, আমি জানি না। কিন্তু সমাজমাধ্যমে আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছিল, সম্পাদিত ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়েছিল। যাতে পরিবারটা ভাঙে। এই জয়চাঁদদের (দ্বাদশ শতকে মগধ ও বারাণসীর রাজা জয়চাঁদ, মেয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায় পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে বদলা নিতে যিনি ঘুরী সুলতানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন) মুখোশ এক দিন খুলবে!’’ কারা এই জয়চাঁদ? তেজপ্রতাপের কথায়, ‘‘অন্তত পাঁচ জন আছে।’’ তেজপ্রতাপ যে আসনে লড়ছেন এ বার, সেই মহুয়ার বর্তমান আরজেডি বিধায়ক, তেজস্বী-ঘনিষ্ঠ মুকেশ কুমার রৌশন তার মধ্যে এক জন, এইটুকুই এখনও তিনি ভেঙেছেন।
বিহারের রাজনৈতিক শিবিরে শোনা যায়, নীতীশ-লালুদের জোট সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে তেজপ্রতাপ জ্যোতিষীদের পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন! বাড়িতে কখনও রাম, কখনও শিব সেজে নিজেকে অবতার মনে করতেন! মাদকের ঘোরে থাকার গুঞ্জনও আছে।স্ত্রী ঐশ্বর্য রাই ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন আগেই। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দারোগা প্রসাদ রাইয়ের নাতনিকে এ যাত্রায় খোঁচানোর চেষ্টা করেও লাভ হল না। জানিয়েছেন, ওই পরিবার নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না।আরজেডি-র এক নেতার মতে, ‘‘তেজু ভাইয়ের মনটা পরিষ্কার। কিন্তু সমস্যা হল, মাথাটাও পরিষ্কার, কোনও পদার্থ নেই!’’
প্রথম পর্বেই তেজপ্রতাপ-তেজস্বীদের ভোট হয়ে গিয়েছে। রাবড়ী, মিসা তেজপ্রতাপের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বহিষ্কারের সময়ে যিনি তেজপ্রতাপের কাণ্ডকারখানার বিরুদ্ধে প্রবল সরব ছিলেন, সেই রোহিনী পর্যন্ত বলেছেন, ‘‘এখন একা একাই লড়ছে। ওর জন্য শুভেচ্ছা থাকল। বোন হিসেবে ভাইয়ের অন্যায় দেখলে বলতেই পারি। কিন্তু সেই ঘটনার পরে আর অন্যায় করেনি। চাই, ভাল কিছু হোক ওর।’’ প্রকাশ্যে তেজস্বীও বলেন, ভাই হলে টান তো থাকেই ইত্যাদি। একেবারেই নীরব ‘লর্ড লালুপ্রসাদ’! তবে সূত্রের খবর, মাঝে মধ্যে তেজপ্রতাপের কাছে ফোন আসে রাবড়ীর। শরীর, খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেন। তেজপ্রতাপকে খোঁচালে শুনতে হয়, ‘‘মা মা-ই হন। এই নিয়ে কোনও কথা নয়।’’ শুনে ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ মনে পড়তে বাধ্য! আর এই ব্রাত্য ভোলেবাবাকে ভোট-প্রচারে কপ্টার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কোন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নেপথ্যে সহযোগিতা করেছেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও উহ্য!
অবশিষ্ট ভারত ওটিটি-র পর্দায় ‘মহারানি’ ওয়েব সিরিজ়ের নতুন সিজ়ন দেখুক। বিহারের জনতা বাস্তবে সিরিজ় দেখছে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)