Advertisement
E-Paper

উদ্বাস্তুর খিদে দেখে ভাত ছেড়ে দিয়েছিলেন, শতবর্ষে পা দিলেন অরুণা

দেশ ভাগের ধাক্কায় গুয়াহাটি স্টেশনে তখন ছিন্নমূল মানুষের ভিড়। তাঁদের শিশুদের খাওয়াতে দুধের বালতি নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলেন কটন কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান যদুলাল মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী অরুণাদেবী। ফেরার সময় বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার তাঁর সঙ্গেই বাড়ি চলে আসে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ১৯:৩৭
ছবি: উজ্জ্বল দেব।

ছবি: উজ্জ্বল দেব।

দেশ ভাগের ধাক্কায় গুয়াহাটি স্টেশনে তখন ছিন্নমূল মানুষের ভিড়। তাঁদের শিশুদের খাওয়াতে দুধের বালতি নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলেন কটন কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান যদুলাল মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী অরুণাদেবী। ফেরার সময় বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার তাঁর সঙ্গেই বাড়ি চলে আসে। বাড়ির বাগানে তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারলেও দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন সকলের মুখে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না অরুণাদেবীর। সেই আক্ষেপে নিজেও অন্নত্যাগ করেছিলেন। আর ভাত খাননি। গত ৬৯ বছর ধরে শুধু চা এবং বিস্কুট খেয়েই সমাজসেবা চালাচ্ছেন অরুণা মুখোপাধ্যায়।

আজ শতবর্ষে পা দিলেন তিনি। উলুবাড়ির সত্যভামা দাস মারা যাওয়ার পরে আপাতত তিনিই শহরে প্রবীণতমা ভোটারও বটে। তবু অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে এখনও অরুণাদেবী চালিয়ে যাচ্ছেন একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি সেলাই শেখানোর স্কুল, আঁকার স্কুল আর গান শেখানোর স্কুল। চোখের দৃষ্টি খানিক ঝাপসা, কানেও অল্প কম শুনছেন। তাই রান্না শেখানো ও বাটিকের স্কুল বন্ধ। কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ, প্রখর স্মৃতি আর প্রবল উৎসাহকে সম্বল করে সেবার কাজে বিরাম নেই। এ দিন জোর করেই অরুণাদেবীর অনুগামীরা তাঁর শতবর্ষের জন্মদিনটা ঘটা করে পালন করলেন।

১৯৬৮ সালে মারা গিয়েছেন স্বামী। চার ছেলে ও মেয়ে সকলেই প্রবাসী ছিলেন। তিন ছেলের মৃত্যু হয়েছে। এখন এক ছেলে ও মেয়ে কানাডা থেকেই মায়ের খবরাখবর রাখেন। নাতি-নাতনি নিয়ে বছরে একবার ঘুরে যান গুয়াহাটি। কিন্তু একাকিত্বে ভোগার সময় কোথায় অরুণাদেবীর? সর্বক্ষণের সঙ্গিনী রূপা দেবনাথকে সঙ্গে নিয়ে সব সময়েই তো কাজে মেতে তিনি। হাতে গড়া ঊষা এমব্রয়ডারি স্কুল, শিল্পী মিউজিক কলেজ, জেএলএম মেমোরিয়াল স্কুল ও আর্ট স্কুলের তদারকিতে এখনও অক্লান্ত।

পল্টনবাজারের কেবি রোডের ঘরের চারদিকে তাঁর হাতের কাজ। কোথাও বাটিক, কোথাও গ্লাস পেন্টিং, কোথাও সফ্ট টয়। বাড়ির বাগান এখনও নিজে হাতে সামলান। সামলান ঘরের কাজও। যতটা পারেন।

আরও পড়ুন: স্ট্রেচার নেই, মৃত ছেলে কাঁধে নিয়ে দৌড়লেন বাবা

শতবর্ষে পা দেওয়া উপলক্ষে এ দিন সন্ধ্যায় সরগরম মুখোপাধ্যায় বাড়ি। গরীব মানুষ খেতে পায় না বলে অন্ন ত্যাগ করা, গরীবদের গরম পোশাক জোটে না বলে শীতেও গরম পোশাক না পরা অরুণাদেবী উৎসবে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু, আত্মীয়-ভক্তদের চাপে শেষমেষ নিজেই পায়েস রান্না করেন তিনি।

বাড়িতে বসে বলছিলেন, "শরণার্থীদের বাড়িতে তোলায় এক দিন এসে স্বামী বলেছিলেন সংসারের টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সে দিন থেকেই নিজের খাওয়ার টাকা বাদ দিলাম। স্বামী ও ছেলেমেয়েরা বাইরে বেরিয়ে গেলে কাগজের ঠোঙা তৈরি ও বিক্রি করে টাকা রোজগার করে শরণার্থীদের অন্নসংস্থান করেছিলাম। রান্না হত কাঠ আর খেজুরপাতা জ্বালিয়ে।"

পরবর্তীকালে গান্ধী বস্তি এলাকায় শরণার্থীদের থাকার জমির বিকল্প ব্যবস্থা হলে মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি ছেড়ে শরণার্থীরা আশ্রয়শিবিরে চলে যান। কিন্তু সমাজসেবার ভূত ততক্ষণে মাথায় চেপেছে। তাই কাজ চালিয়ে গেলেন বিভিন্ন উপায়ে। অনেক দিন পর্যন্ত শরণার্থী পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তিনি বলেন, "প্রথম দিনে স্টেশনে গিয়ে বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর সময় কাতর কণ্ঠে মায়ের দল বলেছিল শুধু বাচ্চাদের খাওয়ালে হবে না, আমাদেরও খেতে দিন, আমরাও বাঁচতে চাই। সেই কথাগুলো এখনও কানে বাজে। যত দিন বাঁচব কাজ চালিয়ে যাব মানুষের জন্য। এখনও শুক্লেশ্বরে গেলে ভিখারিদের কষ্ট দেখে কান্না পায়। কোন মুখে ফের ভাত খাওয়ার কথা ভাবব? সেই বোধ থেকেই ভূপেন হাজরিকা গেয়েছিলেন ‘মানুহ মানুহর বাবে যদি অকণও নে ভাবে’। আমরা আজকাল তাঁর গান গাই বটে, কিন্তু সেই আদর্শ পালন করি না।"

স্বামীর মতো তাঁর সব সন্তানই রয়াসন নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। বিদেশে পাড়ি দেন সবাই। বাড়ি আছে কলকাতাতেও। কিন্তু পল্টনবাজারের বাড়ি আর পাড়ায় চলা স্কুলগুলি ছেড়ে কোথাও নড়তে নারাজ ঢাকা বিক্রমপুরের মেয়ে। কলকাতার আত্মীয়দের মধ্যস্থতায় যদুলালবাবুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে। যদুলালবাবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেছিলেন।

২০১১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে অরুণাদেবীকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করছেন ববিতা শর্মা। তিনিও এদিন অরুণাদেবীকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন। আসেন অনেক শুভানুধ্যায়ী। সকলে যখন কেক খেতে ব্যস্ত, তিনি বলে চলেন, "শুধু চা-বিস্কিট নয়, মানুষের এই ভালবাসাই তো আমার চালিকাশক্তি। শতবর্ষ গুণে লাভ নেই। যত দিন জ্ঞান আছে, কাজ চালিয়ে যেতে চাই।"

refugee guawati
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy