E-Paper

মুখ্যমন্ত্রী পাওয়ার স্বপ্নে তেজস্বীর গড়

বিহারের ‘ভিভিআইপি’ বিধানসভা কেন্দ্র রাঘোপুর। নব্বইয়ের দশকে এই রাঘোপুর থেকে জিতেই প্রথম বার বিধায়ক হয়েছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। লালুর পরে রাবড়ি দেবী রাঘোপুরের বিধায়ক হন। দুজনেই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৪
তেজস্বী যাদব।

তেজস্বী যাদব। — ফাইল চিত্র।

কাছেই গঙ্গা বইছে। দেখা যাচ্ছে গঙ্গার উপরে নতুন তৈরি সেতু। এ বছরের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেছেন। পটনা থেকে ছয় লেনের সেতু ধরে গঙ্গা পেরিয়ে বৈশালী জেলার রাঘোপুরে ঢুকতেই ভাঙাচোরা সরু রাস্তা। টাল সামলাতে না পেরে সাতসকালেই একটা ম্যাটাডোর রাস্তার ধারে কাত হয়ে পড়েছে।

সে দিকে তাকিয়ে বিড়িতে টান দিচ্ছিলেন মহেন্দ্র রাই। সাতসকালে লিট্টির দোকানে আড্ডা বসেছে। লিট্টির সঙ্গে আলু-ছোলার তরকারি, আচার, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজের সঙ্গত।রাঘোপুর এ বার কী চাইছে? মহেন্দ্র উত্তর দিলেন, “এ বার শুধু বিধায়ক নয়, মুখ্যমন্ত্রী চাই।”

বিহারের ‘ভিভিআইপি’ বিধানসভা কেন্দ্র রাঘোপুর। নব্বইয়ের দশকে এই রাঘোপুর থেকে জিতেই প্রথম বার বিধায়ক হয়েছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। লালুর পরে রাবড়ি দেবী রাঘোপুরের বিধায়ক হন। দুজনেই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দশ বছর আগে তেজস্বী যাদবেরও নির্বাচনী কেরিয়ারের শুরু এই রাঘোপুরে। অল্প সময়ের জন্য হলেও দু’বার উপমুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন। তেজস্বী যাদব এ বার বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। রাঘোপুর তাই এ বার শুধু বিধায়ক নয়।মুখ্যমন্ত্রীও চাইছে।

বিহারকে দু’জন মুখ্যমন্ত্রী, একজন উপমুখ্যমন্ত্রী দিয়েছে রাঘোপুর। বদলে কী পেয়েছে? ভাঙাচোরা রাস্তা। নদীতীরস্থ এলাকা বলে বছরের অনেকটা সময় বন্যার জলে ডুবে থাকে রাঘোপুর। জল নেমে গেলে হাঁটু সমান পাঁক। দলিত মহল্লার বিলাই পাসোয়ান ক্ষোভ উগরে দেন, “সরকারি স্কুল নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই।” নীতীশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনায় দশ হাজার টাকা পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী মহিমা দেবী। মহল্লার মহিলাদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে দুধের ব্যবসা শুরু করেছেন। মহিমার প্রশ্ন, “ভোটের সময় ছাড়া তেজস্বীকে রাঘোপুরে কেউ দেখেছে?” দু’দিন আগে রাঘোপুরে ‘রোড-শো’ করতে এসে রাবড়ি দেবীকে ছেলের সম্পর্কে নালিশ শুনতে হয়েছে, ‘আপনার ছেলে রাঘোপুরকে সৎ ছেলের মতো দেখে!’ রাঘোপুরে জেডিইউ প্রার্থী সতীশ কুমার যাদব প্রচারে একটাই প্রশ্ন তোলেন, “তেজস্বী যাদব কেন দশ বছর বিধায়ক থেকে রাঘোপুরকে একটা ডিগ্রি কলেজ, হাসপাতাল দিতে পারলেন না?”

সতীশ এক বার ২০১০ সালে রাঘোপুরে রাবড়ি দেবীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। তার পর তেজস্বী রাঘোপুর পুনর্দখল করেন। এ বারও সতীশ ‘জায়ান্ট কিলার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। পারবেন?

লিট্টির দোকানে মহেন্দ্র রাই হাতের লাঠি মাটিতে ঠুকে বলেন, “লালুর বেটাই জিতবে। গোটা যাদব সমাজ ভোট দিয়ে জেতাবে। রাঘোপুর যা পেয়েছে, অনেক পেয়েছে। লালুপ্রসাদ না থাকলে রাঘোপুর সেটাও পেত না।”

উন্নয়নের মাপকাঠিতে নয়। গোটা বিহারের মতো রাঘোপুরেও ভোট হবে অনেকটাই জাতপাতের ভিত্তিতে। রাঘোপুরে যাদবরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা হাত উপুড় করে যাদব কুলপতি তেজস্বীকে ভোট দেবেন। অভাব-অভিযোগ থাকলেও যাদব সমাজ জানে, বিহারে ফের যাদবের লাঠি ঘোরাতে হলে আরজেডি-র ‘লানটেন’ বা লণ্ঠন চিহ্নে ভোট দিতে হবে। ভোটের ময়দানে তেজস্বী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রতিটি পরিবারের জন্য সরকারি চাকরি। লক্ষ্য তরুণ ভোট। নিয়মিত সরকারি চাকরির জন্য কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন।

রাঘোপুর কি বিশ্বাস করে, এত লোককে চাকরি দেওয়া সম্ভব? রুস্তমপুর গ্রামের বিকাশ যাদব বলেন, ‘‘পড়াশোনা করে থাকলে সরকারি চাকরি পাবে। না হলে কী ভাবে চাকরি দেবে?’’ কয়েক বছর আগে স্কুলশিক্ষকের চাকরি পাওয়া বিকাশ বলেন, ‘‘তেজস্বী যে ১৭ মাস উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সে সময় ২ লক্ষ স্কুল শিক্ষকের চাকরি হয়েছিল। পুলিশে চাকরি হয়েছিল। সব মিলিয়ে পাঁচ লক্ষ চাকরি হলেও কোনও প্রশ্নপত্র ফাঁস বা ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ ওঠেনি। তেজস্বী প্রমাণ করেছেন, চাইলে সরকারি চাকরি দেওয়া সম্ভব।’’ তেজস্বী নিজেও বারবার এ নিয়ে ঢাক পেটাচ্ছেন। কিন্তু বিজেপি বলছে, যা হয়েছে নীতীশের আমলেই। তাতে তেজস্বীরকৃতিত্ব কোথায়?

পটনা থেকে রাঘোপুরে পৌঁছতে এখন মাত্র আধ ঘন্টা সময় লাগে। এক সময় পটনা থেকে রাঘোপুর আসতে হত পন্টুন সেতু ধরে বা বর্ষার সময় নৌকা চেপে। সময় লাগত ছয় থেকে আট ঘন্টা। তখন রাঘোপুরে গাঁজার চাষ, বালি মাফিয়াদের অবৈধ কারবার চলত। জনশ্রুতি, লালু রাঘোপুরের মানুষকে বুঝিয়েছিলেন, তিনি গঙ্গার উপরে সেতু তৈরি করছেন না। কারণ তা হলে পুলিশ চটজলদি পটনা থেকে রাঘোপুরে পৌঁছে যাবে!

শুধু যাদব-গড় রাঘোপুর নয়। গোটা বিহারেই তেজস্বীর সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ, লালু জমানার সেই জঙ্গল রাজের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা। তরুণ ও মহিলাদের ভোট টানা। তেজস্বী মুখ্যমন্ত্রী হলে যাদবরা সব ক্ষমতা, সুবিধা দখল করে নেবে বলে ব্রাহ্মণ, রাজপুত, যাদব বাদে অন্যান্য ওবিসি, ইবিসি ভোট এককাট্টা হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কাও থাকছে। লালুপ্রসাদের জমানা থেকে আরজেডি-র বিশ্বস্ত ভোটব্যাঙ্ক রাঘোপুরের ভোটাররা বলবেন, তেজস্বী ‘মাই বহেন মানসম্মান যোজনা’র ঘোষণা করেছিলেন বলেই নীতীশ কুমার মহিলা রোজগার প্রকল্প চালু করে ভোটের আগে দশ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু নীতীশ এখনও তেজস্বীর থেকে পিছিয়ে।

কী ভাবে?

রাঘোপুরের উত্তর, তেজস্বী তো ২০০ ইউনিট মুফতে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলেছেন। নীতীশ এখন মাত্র ১২৫ ইউনিট বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিচ্ছেন!

রাঘোপুর থেকে এবার তেজস্বী যাদব যে হ্যাটট্রিক করবেন, তা প্রায় নিশ্চিত। রাঘোপুর এ বার বিহারকে মুখ্যমন্ত্রী দেওয়ার হ্যাটট্রিক করবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tejashwi Yadav Bihar Assembly Election 2025

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy