বিস্ফোরণের পরে। রবিবার উরিতে। ছবি: পিটিআই
ভোর সওয়া পাঁচটা। উত্তর কাশ্মীরে উরির সেনা ঘাঁটিতে ডোগরা ও বিহার রেজিমেন্টের জওয়ানদের অনেকেই তখন তাঁবুতে ঘুমিয়ে। আচমকা শুরু হয় বিস্ফোরণ। পরের পর পড়তে থাকে গ্রেনেড। তিন মিনিটে ১৭টি। ডিজেলের ডাম্পারে বিস্ফোরণ হলে আগুন ধরে যায় তাঁবুতে। জওয়ানরা ছুটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেই ছিটকে আসতে থাকে একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলের গুলি। শুরু হয়ে যায় গুলির লড়াই। যে সংঘর্ষ ও তাঁবুর আগুনে পুড়ে আজ মারা গিয়েছেন মোট ১৭ জন জওয়ান। জখম হয়েছেন আরও ৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘণ্টা পাঁচেকের লড়াইয়ে খতম করা হয়েছে চার ফিদায়েঁ জঙ্গিকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে পাকিস্তানের ছাপওয়ালা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র! সেনাবাহিনী জানিয়েছে, জইশ-ই-মহম্মদ এই হামলা চালিয়েছে।
পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলার স্মৃতি এখনও দগদগে। গত ২ জানুয়ারি সেখানেও জইশ জঙ্গিরাই হামলা চালিয়েছিল। গত সপ্তাহে এই পাক জঙ্গি সংগঠনটিই এক ভিডিও প্রকাশ করেছিল শ্রীনগরে। তাতে হিজবুল কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানির হত্যার জন্য সেনাবাহিনী ও তাদের চরেদের উদ্দেশে বিষোদ্গার করে জানানো হয়, এর উপযুক্ত বদলা নেওয়া হবে। এর দিন সাতেক পরেই ঘটল এই আক্রমণ। ২০০২ সালের পরে এত বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা আর ঘটেনি জম্মু-কাশ্মীরে। ২০০২-এর ১৪ মার্চ ৩ জঙ্গির তাণ্ডবের সাক্ষী হয়েছিল জম্মুর কালুচক। সেনা, সেনা পরিবারের লোকজন ও সাধারণ নাগরিক মিলিয়ে মোট ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ঘটনাস্থল ছিল নিয়ন্ত্রণরেখার অদূরে। আজ যেখানে আত্মঘাতী হামলা হল, সেখান থেকেও নিয়ন্ত্রণরেখা বেশি দূরে নয়।
মনে করা হচ্ছে, রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই উরিতে হামলা চালাতে এসেছিল চার পাক জঙ্গি। ভোর পাঁচটা নাগাদ পিছনের দিক দিয়ে তারা সেনাঘাঁটিতে ঢোকে। হামলা শুরু করে প্রশাসনিক ইউনিটে। সেনাবাহিনীর একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে যে মানচিত্র পাওয়া গিয়েছে, তাতে হামলার পুরো ছকটি রয়েছে। ওই মানচিত্রটি থেকে স্পষ্ট, ফৌজিদের নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। প্রথমে প্রশাসনিক ভবনে ও মেডিক্যাল ইউনিটে হামলা চালানোর পরে অফিসারস মেসে গিয়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর ছক ছিল তাদের। কিন্তু তেলের ডাম্পারে বিস্ফোরণ হতেই দিশেহারা হয়ে যায় হামলাকারীরা। সেনা জওয়ানদের পাল্টা গুলির মুখে তারা আশ্রয় নেয় দু’টি বাড়িতে। সেখান থেকেই এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। শেষে হেলিকপ্টার থেকে প্যারাট্রুপার নামিয়ে খতম করা হয় জঙ্গিদের। নিহত জওয়ানদের মধ্যে ১৫ জন ছয় বিহার রেজিমেন্টের এবং ২ জন দশ ডোগরা রেজিমেন্টের।
এই হামলার পিছনে পাকিস্তানের হাত স্পষ্ট হতেই ভারতীয় সেনার ডিজিএমও (মিলিটারি অপারেশনস-এর প্রধান) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিংহ হটলাইনে পাক ডিজিএমও-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হামলাকারীদের অস্ত্রে পাক চিহ্ন ও পাখতুন ভাষায় হামলার ছক তথা মানচিত্রের কথা জানান। তাতে কোনও ফল মেলার আশা অবশ্য করছে না ভারত। কারণ, জঙ্গি হামলায় মদতের অভিযোগ উঠলেই অতীতে প্রতি বার পাকিস্তান যা করেছে, এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র নাফিস জাকারিয়া আজ দাবি করেছেন, ‘‘উরি হামলায় পাক যোগের যে অভিযোগ ভারত করছে, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন।’’
পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এই মুহূর্তে আমেরিকায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েছেন তিনি। তাঁকে আরও বেশি দুর্বল করে দিয়ে, ভারত-বিরোধী অবস্থান আরও জোরালো করতেই পাক সেনা ঠিক এই সময়ে জঙ্গিদের এমন একটি হামলা করাল বলে মনে করা হচ্ছে।
এ দিনের হামলার পরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সুরে ঘোষণা করেছে, এর ‘যোগ্য জবাব’ দেওয়া হবে। কিন্ত কী হবে সেই যোগ্য জবাব? সেটাই এখন সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সামনে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘উরিতে কাপুরুষোচিত এই সন্ত্রাসবাদী হামলার তীব্র নিন্দা করছি। দেশবাসীকে কথা দিচ্ছি, যারা এই জঘন্য কাজের পিছনে রয়েছে, তারা রেহাই পাবে না।’’ সুর আর এক ধাপ চড়িয়ে আরএসএসের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন সেটাই ঠিক রাস্তা। সংযত থাকার পরিস্থিতি আর নেই। একটা দাঁতের বদলে এখন চাই গোটা চোয়াল।’’
কিন্তু শাস্তিটা কাকে দেওয়া হবে? এবং কী ভাবে?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র যোষণা করতে হবে। বিশ্বের বাকি দেশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।’’ কিন্তু সেনাকর্তাদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানকে একঘরে করার যত চেষ্টাই হোক তাতে তাদের কিছু এসে যায় না। রক্ত ঝরছে ভারতের। হামলাকারী ও তার চক্রীদের বাস্তবের মাটিতে আঘাত না করলে, তারা এই যন্ত্রণা বুঝবে না বা বিরতও হবে না।
কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথাগত যুদ্ধে বা সীমিত যুদ্ধে, এমনকী ‘সার্জিক্যাল অপারেশন’ তথা শল্য চিকিৎসার মতো কোনও অভিযানে নামতে হলেও ভারতকে পাশে টানতে হবে আন্তর্জাতিক মহল বা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে। আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিভিন্ন দেশ উরি হামলার তীব্র নিন্দা করলেও চিনের মতো দেশ যেখানে হাফিজ সইদের মতো জঙ্গি নেতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমিত কোনও সামরিক পদক্ষেপ করতে হলেও দশ বার ভাবতে হবে ভারতকে। ওসামা বিন লাদেনকে খতম করতে ‘ঘুস কর মারো’ নীতি নেওয়ার যে ক্ষমতা আমেরিকার রয়েছে, ভারতের পক্ষে তা জোটানো শক্ত। এই পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী শিবিরের শীর্ষ নেতারা কড়া কড়া বিবৃতি দিলেও পাল্টা কী পদক্ষেপ করতে চলছে দিল্লি, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের রাশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। সফর বাতিল করে তিনি জরুরি বৈঠক করছেন দিল্লিতে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও ছিলেন বৈঠকে।
উরিতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর ও সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ। পরে শ্রীনগরে তাঁরা শীর্ষস্থানীয় অন্য সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেনাবাহিনীকে সন্ত্রাস মোকাবিলায় অনেক বেশি কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy