আপাতত ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে যুদ্ধকে ধামাচাপা দিয়ে বিরতির প্রয়াস চলছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সংঘাত যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল আপাতত কিছু দিনের জন্য তা শান্ত হবে। কিন্তু এই ঘটনা নিঃসন্দেহে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করল।
প্রাথমিক ভাবে ইরানকে আক্রমণের প্রশ্নে আমেরিকা ইজ়রায়েলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর পশ্চিম এশিয়ায় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। আপাতত তাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরতি দিলেও ভবিষ্যতের জন্য ফাটল ধরেই রইল। সেখানে আবারও সঙ্কট তৈরি হতে পারে খুব শীঘ্রই। সে ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সংযোগের পরিকল্পনা ব্যাহত হবে, অন্য দিকে সার্বিক ভাবে বিশ্ব রাজনীতিতেও ব্লক রাজনীতি আরও মাথাচাড়া গিয়ে উঠবে বলে মনেকরা হচ্ছে।
কূটনৈতিক শিবিরের মতে, পশ্চিম এশিয়ার এই অশান্তির একাধিক কূটনৈতিক দিক রয়েছে। প্রথমত, পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বৃহত্তর পরিকল্পনাগুলি ভেস্তেযাওয়া। জ্বালানির দাম বাড়বে, অঞ্চলের কৌশলগত চিড়গুলিও এমনভাবে বাড়বে যে নয়াদিল্লির পক্ষে তাকে অস্বীকার করে এগিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বড় সংখ্যক অনাবাসী, প্রবাসী ভারতীয় বিদেশি মুদ্রা পাঠান দেশে। সেখানেও অনিশ্চয়তা কমবেশি তৈরি হয়েছে বলে খবর। ভারতে আয়োজিত জি২০সম্মেলনে যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, সেই ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর এবং চাবাহার প্রকল্পের কাজও আপাতত বিশ বাঁও জলে। ওই বন্দরকে মধ্য এশিয়ার দরজা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল নয়াদিল্লি। যতই সংঘর্ষ বিরতি হোক, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে এখনও সময় লাগবে।
কূটনৈতিক শিবিরের মতে, পশ্চিম এশিয়ায় অস্থিরতার প্রভাব বৃহত্তর। এটা ঘটনা যে ইরানের সঙ্গে তার অনেক প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরই সদ্ভাব নেই। কিন্তু সে দেশের পরমাণু ভাঁড়ারে আমেরিকার বোমা বর্ষণের সিদ্ধান্ত এবং ইজ়রায়েলের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে ইরানের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির পক্ষে তেল আভিভের সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে করমর্দন করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুন্নি অধ্যুষিত পশ্চিম এশিয়ায় ইরান খুব জনপ্রিয় নয় ঠিকই, কিন্তু ইজ়রায়েলও ঘৃণ্য তাদের কাছে। বিশেষ করে গাজ়ার নিরপরাধ মানুষের উপর আক্রমণের পর। এই সুযোগে রাশিয়া এবং চিন তাদের ভূকৌশলগত প্রভাব এই অঞ্চলে খাটাতে শুরু করেছে। ইজ়রায়েল এবং আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার এ এক নতুন মঞ্চ তাদের কাছে। ফলে এই অঞ্চলের অঙ্ক আরও জটিলহয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে ইউরোপ এখনও সে ভাবে স্বর চড়াচ্ছে না, অপেক্ষা করছে। তবে সূত্রের মতে, অবশ্যই তারা প্রশ্ন তুলবে, কেন আমেরিকা দুরের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেছে? কেন আমেরিকা তাদের সুরক্ষার জন্য নেটো শরিকদের মূল্য দিতে বাধ্য করছে কেন মাঝপথে ইউক্রেনের হাত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? ইরান-ইজ়রায়েল অশান্তির ফলে সরাসরি দুর্ভোগে পড়েছে ইউরোপ। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শান্তির টেবিলে বসার সুযোগ অনেকটাই পিছিয়ে গেল। ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতার কোনও লক্ষণই মস্কো দেখাচ্ছে না।
সব শেষে আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলের যৌথ হামলা কোনও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের ধার ধারেনি। এর ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বেশি করে খাটো হচ্ছে। আমেরিকার এই আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইনের দুর্বলতা হিসেবেই প্রতিপন্ন হচ্ছে বলে মনে করছেকূটনৈতিক শিবির।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)